হার্ডিঞ্জ ব্রিজ কুষ্টিয়া
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ রেলসেতু, যা বাংলাদেশের পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি এলাকা থেকে কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি পদ্মা নদীর ওপর অবস্থিত এবং বাংলাদেশের দীর্ঘতম রেলসেতুগুলোর মধ্যে অন্যতম। সেতুটি পাকশি রেলস্টেশনের ঠিক দক্ষিণে অবস্থান করছে।
এই রেলসেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯১৫ সালে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে সেতুটির নামকরণ করা হয় “হার্ডিঞ্জ ব্রিজ”।
সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ১,৭৯৮.৩২ মিটার (প্রায় ৫,৮৯৪ ফুট বা ১.৮ কিলোমিটার)। এটি দুটি ব্রড-গেজ রেললাইন বিশিষ্ট, যা দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

Construction of Hardinge Bridge 1910, ব্রিজের নির্মাণ কাজ ১৯১০
একদিকে অনন্য প্রকৃতির সৌন্দর্য, অন্যদিকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুগে যুগে আগত শাসক, শোষক এবং প্রজন্মের সাক্ষ্যবহনকারী—এমনই এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হলো হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। বাংলাদেশের অন্যতম স্থাপত্য-ঐতিহ্য এই রেলসেতুটি আজও বীরদর্পে দাঁড়িয়ে আছে পদ্মা নদীর বুকে। সময়ের বিবর্তনে পদ্মার খরস্রোতা, উচ্ছ্বল ঢেউ এবং যৌবন ম্লান হয়ে গেলেও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ রয়ে গেছে অটুট ও চিরসবুজ। এটি আজও দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ রেল যোগাযোগের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করছে।
১৮৮৯ সালে তৎকালীন অবিভক্ত ভারত সরকারের পক্ষ থেকে অসম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড এবং উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার রেল যোগাযোগ সহজ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পদ্মা নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। তবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আসে প্রায় দুই দশক পরে।
১৯০৮ সালে ব্রিজ নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হলে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রকৌশলী স্যার রবার্ট গেইলস-কে। এর পর ১৯০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণকাজ শুরু হয় এবং ১৯১৫ সালে এটি সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অবস্থিত বাংলাদেশের পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে। এটি পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি এলাকা থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পর্যন্ত বিস্তৃত। এটি শুধুমাত্র দেশের দীর্ঘতম রেলসেতু হিসেবেই নয়, বরং একটি প্রকৌশল কীর্তি হিসেবেও বিবেচিত। ব্রিজটি নির্মাণের সময় পদ্মা নদীর ছিল প্রচণ্ড স্রোত, গা শিউরানো ঢেউ এবং তীব্র জলপ্রবাহ, যা নির্মাণকাজকে করেছিল চরম চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু সব বাধা পেরিয়ে এটি আজও দেশের অন্যতম ব্যস্ততম ও গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শুধু একটি অবকাঠামো নয়, এটি ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষ্য। একসময় যখন পদ্মার তরঙ্গমালা ছিল উন্মত্ত ও উদ্দাম, তখনও এই ব্রিজ সাহসিকতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। এখন হয়তো পদ্মার জলরাশি আগের মতো তেজী নয়, কিন্তু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের গর্বিত দাঁড়িয়ে থাকা একটুও কমেনি। এটি আজও দেশের অগ্রযাত্রার সঙ্গে মিশে আছে দৃঢ়তা, ঐতিহ্য ও কীর্তির প্রতীক হয়ে।

হার্ডিঞ্জ-ব্রিজ, Hardinge Bridge
ঐতিহাসিক হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মাণে নিযুক্ত ছিলেন প্রায় ২৪ হাজার ৪০০ শ্রমিক, যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রমে এই প্রকল্প সম্পন্ন করেন। তৎকালীন সময়ে এর নির্মাণ ব্যয় হয়েছিল ৩ কোটি ৫১ লাখ ৩২ হাজার ১৬৪ ভারতীয় রুপি। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের নাম অনুসারে এই সেতুর নামকরণ করা হয় “হার্ডিঞ্জ ব্রিজ”।
এই রেলসেতুর মোট দৈর্ঘ্য ১,৭৯৮.৩২ মিটার, অর্থাৎ প্রায় ১.৮ কিলোমিটার বা ৫,৮৯৪ ফুট। সেতুটির ওপর রয়েছে দুটি ব্রডগেজ রেললাইন, যার মাধ্যমে আজও গুরুত্বপূর্ণ রেল যোগাযোগ চালু রয়েছে। এর স্থাপত্য ও নকশা প্রণয়ন করেছিলেন খ্যাতিমান প্রকৌশলী আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল। ব্রিজটিতে রয়েছে মোট ১৫টি স্প্যান, প্রতিটির দৈর্ঘ্য ১২০ মিটার।
১৯১৫ সালের ৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঐতিহাসিক সেতুটি চালু করা হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই ব্রিজ ব্যবহার করে ট্যাংক, অস্ত্রশস্ত্র এবং সেনা পরিবহন করত। এই কারণে মিত্র বাহিনীর বিমান থেকে ব্রিজের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়, যার ফলে ১২ নম্বর স্প্যান সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ে এবং ৯ ও ১৫ নম্বর স্প্যান আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে ব্রিটিশ সরকারের সহায়তায় ক্ষতিগ্রস্ত অংশসমূহ পুনঃনির্মাণ ও মেরামত করা হয়।
সবশেষে, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর থেকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ২০১৫ সালে ব্রিজটি তার গৌরবময় শতবর্ষ পূর্ণ করে, যা বাংলাদেশের রেল ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক।

হার্ডিঞ্জ-ব্রিজ, Hardinge Bridge
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক, লাল রঙে শৈল্পিক কারুকার্যে নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ শতবর্ষ পেরিয়ে আজও দর্শনার্থীদের আকর্ষণে বিমুগ্ধ করে চলেছে। ১৯১৫ সালে পদ্মা নদীর ওপর স্থাপিত এই রেলসেতুটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক গর্বিত স্থাপত্য হিসেবে।
ব্রিজটির পাশেই ২০০৪ সালে নির্মিত হয়েছে একটি দৃষ্টিনন্দন সড়কসেতু—‘লালন শাহ সেতু’, যা কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত সুফিসাধক ফকির লালন শাহের নামে নামকরণ করা হয়েছে। পদ্মার ওপর যুগল সেতু হিসেবে এই দুটি স্থাপত্য একসঙ্গে সৃষ্টি করেছে এক অপূর্ব দৃষ্টিসুখকর দৃশ্য।
প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক এখানে ছুটে আসেন এই প্রাকৃতিক ও স্থাপত্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কেউ কেউ নৌকা ভ্রমণের মাধ্যমে পদ্মার বুকে এই দুই সেতুর সৌন্দর্যে মোহিত হন। শুধু দেশীয় নয়, প্রতিবছর বহু বিদেশি পর্যটকও আসেন এই ঐতিহাসিক ব্রিজটি স্বচক্ষে দেখতে। এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজ আজও কৌতূহল আর বিস্ময়ের প্রতীক হয়ে টিকে আছে মানুষের হৃদয়ে।

হার্ডিঞ্জ-ব্রিজ, Hardinge Bridge
| বিষয় | তথ্য |
| অফিসিয়াল নাম | হার্ডিঞ্জ ব্রিজ |
| অন্য নাম | হার্ডিঞ্জ সেতু |
| অবস্থান | পাবনা জেলা ও কুষ্টিয়া জেলা, বাংলাদেশ |
| স্থানাঙ্ক | ২৪°০৪′০৪″ উত্তর, ৮৯°০১′৪৫″ পূর্ব |
| নদীর নাম | পদ্মা নদী |
| বহন করে | ব্রড-গেজ রেললাইন |
| মোট দৈর্ঘ্য | ১,৭৯৮.৩২ মিটার (প্রায় ৫,৯০০ ফুট) |
| নির্মাণ কাজ শুরু | ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ (প্রাথমিক নির্মাণকাল) |
| চালু হওয়ার তারিখ | ৪ মার্চ ১৯১৫ |
| নকশাকার | স্যার আলেকজান্ডার মেয়াডোস রেন্ডেল |
| নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান | ব্রিথওয়ায়েট ও কির্ক |
| উদ্দেশ্য | রেলওয়ে সংযোগ স্থাপন (ঈশ্বরদী-ভেড়ামারা রেলপথে ট্রেন চলাচল) |
| ব্যবহারকারি সংস্থা | বাংলাদেশ রেলওয়ে |
| রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব | বাংলাদেশ রেলওয়ে |
| নির্মাণকালীন প্রেক্ষাপট | ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয় উপমহাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের অংশ হিসেবে নির্মিত |
| শতবর্ষ পূর্তি | ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ |
হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি পদ্মা নদীর উপর অবস্থিত এবং এটি ঈশ্বরদী ও ভেড়ামারার সীমান্ত অঞ্চলে বিস্তৃত। এই সেতুটি কেবলমাত্র রেল চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
