রঞ্জুউর রহমান ॥ নানা আয়োজনে কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস পলিত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) সকাল নয়টায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেলা ইউনিট কমান্ড এর আয়োজনে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হয়। র্যালিটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শহীদ বেদী ডি সি. কোর্ট চত্তর এসে শেষ হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে বীর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জেলা পুলিশ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ফুল দিয়ে শহীদদেও প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এরপর জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যদিয়ে জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের পতাকা উত্তোলন শেষে শহীদদের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ দোয়া ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে আলোচনা সভায় অংশ নেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন, জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) শিকদার মোহাম্মদ হাসান ইমাম, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কুষ্টিয়া জেলা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার হাজী রফিকুল আলম টুকু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকবৃন্দরা।
আলোচনা সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন বলেন, আজ কুষ্টিয়া পাক হানাদার মুক্ত দিবস। আমাদের গৌরবের, বিজয়ের এবং আত্মত্যাগের দিন। এই দিনে আমরা স্মরণ করি সেইসব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে, যারা জীবন, রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের প্রিয় কুষ্টিয়াকে শত্রুমুক্ত করেছিলেন। তাঁদের সাহস, বীরত্ব এবং দেশপ্রেম আজও আমাদের অনুপ্রেরণা।
উল্লেখ্য, ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া মুক্তদিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম, ২২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অসংখ্য নীরব ত্যাগের মধ্যদিয়ে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের কুষ্টিয়া থেকে বিতাড়িত করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। কালেক্টরেট চত্বরে উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্ন থেকেই কুষ্টিয়া ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিলের প্রথম দিকে এখানে ইপিআর, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষ মিলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই প্রতিরোধে যোগ দেন, যা পরবর্তীতে সুসংগঠিত মুক্তিযোদ্ধা বাহিনীতে রূপ নেয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস জুড়ে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানে গেরিলা হামলা, সম্মুখযুদ্ধ ও প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয় চূড়ান্ত মুক্তির পথ। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ১৬ এপ্রিল থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুষ্টিয়া জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ২২টি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। মিরপুর, ভেড়ামারা, দৌলতপুর, খোকসা, কুমারখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর সুসজ্জিত ঘাঁটির বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই চালান।
পাকবাহিনীর ক্যাম্প, ব্রিজ, সড়ক ও রসদ সরবরাহ লাইনে ধারাবাহিক আক্রমণ চালিয়ে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়া হয়। প্রতিটি যুদ্ধে বহু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীরও বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। তারা কুষ্টিয়ায় অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহরের প্রবেশমুখ, গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও স্থাপনার আশপাশে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী পাক সেনাদের সঙ্গে চূড়ান্ত লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। ভোর থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধে গোলাগুলি, মর্টার শেল ও ভারী অস্ত্রের প্রচণ্ড গর্জনে পুরো শহর কেঁপে ওঠে। কৌশলগত স্থানে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা ভেঙে দেন। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে ও আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। তাদের অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়।
১১ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত ঘোষণা করা হয় এবং দিনটিকেই ‘কুষ্টিয়া মুক্ত দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত কুষ্টিয়া শহরের কালেক্টরেট চত্বরে তৎকালীন রাজনৈতিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সময় প্রাদেশিক পরিষদের জোনাল চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ চৌধুরীসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত থেকে শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানান। এই পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই প্রতীকীভাবে স্বাধীন কুষ্টিয়ার জন্ম এবং মুক্তাঞ্চল হিসেবে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালুর সূচনা ঘটে।
