Shelaidaha kuthibadi
বাংলা সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতির অমর পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্মের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি। এটি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের খোরেশদপুর গ্রামে, কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘেরা এই প্রাসাদোপম ভবনটি এখন “শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি জাদুঘর” নামে পরিচিত, যা কবিগুরুর স্মৃতি বহন করছে এক অনন্ত গৌরবে।

শিলাইদহ রবীন্দ্র কু – ঠিবাড়ি, Inside of Shilaidaha Rabindra Kuthibadi
১৮০৭ সালে কবিগুরুর দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এ অঞ্চলের জমিদারি পান। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে এসে জমিদারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯০১ সাল পর্যন্ত এখানেই বসবাস ও জমিদারি পরিচালনা করেন।
এই সময়কালেই রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজীবনের অন্যতম সৃজনশীল অধ্যায় শুরু হয়। এখানেই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘চৈতালী’, ‘চৈতী গান’, প্রভৃতি। এখানেই তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের ইংরেজি অনুবাদের কাজ শুরু করেন, যার জন্য পরবর্তীতে তিনি ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
শিলাইদহ কুঠিবাড়িটি একটি তিনতলা ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপনা, যা নির্মিত হয়েছিল ইট, চুনসুরকি ও কাঠের সমন্বয়ে। চারপাশে প্রশস্ত বারান্দা, খোলা ছাদ, উঁচু জানালা ও নদীমাতৃক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য একে করে তুলেছে অনন্য। ভবনের সামনে রয়েছে একটি বড় সরোবর, যার তীরে কবিগুরুর ব্যবহৃত বজরার অনুকৃতি সংরক্ষিত আছে — সেই বজরাতেই তিনি নদীপথে ঘুরে বেড়াতেন এবং অনুপ্রেরণা পেতেন তাঁর অসংখ্য কবিতা ও গান রচনায়।
১৯৫৮ সাল থেকে কুঠিবাড়িটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে সংরক্ষিত রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭১ সালে একে জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, ছবি ও শিল্পকর্ম সংগ্রহ করে জাদুঘর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বর্তমানে পুরো ভবনটি জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় মোট ১৬টি গ্যালারি কক্ষ রয়েছে, যেখানে কবির জীবন ও কর্মের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে—
কবি রবীন্দ্রনাথ
শিল্পী রবীন্দ্রনাথ
জমিদার রবীন্দ্রনাথ
কৃষকবন্ধু রবীন্দ্রনাথ
রাজনৈতিক চিন্তাবিদ ও মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ
এছাড়াও রয়েছে তাঁর বাল্যকাল থেকে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত তোলা বিরল সব আলোকচিত্র, নিজস্ব চিত্রকর্ম, হাতে লেখা পান্ডুলিপি, এবং ব্যবহৃত আসবাবপত্র।
জাদুঘরে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু নিদর্শন সংরক্ষিত আছে, যেমন—
চঞ্চলা ও চপলা নামের দুটি স্পিডবোট
কাঠের পল্টুন ও ৮বেহারা পালকি
কাঠের চেয়ার, টি-টেবিল, সোফাসেট, আরাম চেয়ার, পালঙ্ক
তাঁর জমিদারি সময়ের নথিপত্র ও পাণ্ডুলিপি
ব্যক্তিগত ব্যবহৃত পোশাক ও গৃহস্থালির সামগ্রী
এই নিদর্শনগুলো রবীন্দ্রনাথের জীবনযাপন, নন্দনচেতনা ও কর্মধারার এক অমূল্য দলিল হয়ে আছে।
টিকিট প্রাপ্তিস্থান:
জাদুঘরের মূল গেটের পাশেই টিকিট কাউন্টার অবস্থিত।
| দর্শনার্থীর ধরন | প্রবেশমূল্য |
|---|---|
| সাধারণ দর্শনার্থী | ১৫ টাকা |
| মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী | ৫ টাকা |
| সার্কভুক্ত বিদেশি নাগরিক | ৫০ টাকা |
| অন্যান্য বিদেশি দর্শনার্থী | ১০০ টাকা |
| পাঁচ বছরের নিচের শিশু | বিনামূল্যে |
খোলার সময়সূচি:
| ঋতু | খোলার সময় | বন্ধের সময় | মধ্যাহ্ন বিরতি |
|---|---|---|---|
| গ্রীষ্মকাল | সকাল ১০টা | সন্ধ্যা ৬টা | দুপুর ১টা–১.৩০টা |
| শীতকাল | সকাল ৯টা | বিকেল ৫টা | দুপুর ১টা–১.৩০টা |
শুক্রবারে জুমার নামাজের জন্য দুপুর ১২:৩০ থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটি এবং
সোমবারে দুপুর ২টা থেকে জাদুঘর খোলে।
সরকার ঘোষিত বিশেষ দিবসগুলোতেও জাদুঘর খোলা থাকে।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি শুধু সাহিত্যপ্রেমীদের নয়, ইতিহাস ও সংস্কৃতিপ্রেমী সাধারণ দর্শনার্থীদের কাছেও এক অনন্য আকর্ষণ। কুষ্টিয়া শহর থেকে সহজেই পৌঁছানো যায় রিকশা, সিএনজি বা স্থানীয় বাসে। কুঠিবাড়ির চারপাশে এখন গড়ে উঠেছে হস্তশিল্পের দোকান, স্থানীয় খাবারের রেস্টুরেন্ট ও গাইড সার্ভিস, যা পর্যটকদের ভ্রমণকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

কুঠিবাড়ির সরোবরে রক্ষিত কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক ব্যবহৃত বজরার অনুকৃতি
শিলাইদহ রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি কেবল একটি স্থাপনা নয়—এটি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয় ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক।
নদী, প্রকৃতি ও শিল্পের অনুপ্রেরণায় ভরা এই কুঠিবাড়ির প্রাঙ্গণে পা রাখলে আজও যেন শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের গানের সুর, কবিতার ছন্দ, আর মাটির গন্ধে মিশে থাকা তাঁর অমর উপস্থিতি।
