ইবি প্রতিনিধি ॥ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) সেন্ট্রাল ল্যাবে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে লেজার স্ক্যানিং কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ ক্রয়ে প্রায় ২ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে সেন্ট্রাল ল্যাবের সাবেক পরিচালক বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মহা. আনোয়ারুল হক স্বপনের বিরুদ্ধে। ১ কোটি ৯২ লাখ ৫২ হাজার টাকার আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে শিক্ষা অডিট অধিদফতর বিষয়টি তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি পাঠিয়েছে। ২০১৫ সালেও শাহ আজিজুর রহমান হলের প্রভোস্ট থাকাকালীন সময় সরঞ্জাম ক্রয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত কমিটি গঠন করলেও আলোর মুখ দেখেনি।
এছাড়া বিভাগীয় চেয়ারম্যান থাকাকালে শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, ফার্স্ট ক্লাস প্রার্থীকে বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে সেকেন্ড ক্লাস প্রাপ্ত ড. মো. জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষা অডিট অধিদফতর থেকে গত ১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেরিত চিঠিতে বলা হয়, ডিপিপির প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থ বছরে মাইক্রোস্কোপ ক্রয়ে প্রকল্প নির্দেশিকার একাধিক ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অডিট চিঠিতে উল্লেখ করা হয়-ল্যাব পরিচালক প্রফেসর ড. মুহা. আনোয়ারুল হক স্বপন যে দর উল্লেখ করেছিলেন, সেই দরেই পণ্য ক্রয় করা হয়েছে; বাজারদর যাচাই করে অফিসিয়াল কষ্ট ইস্টিমেট তৈরি না করায় ব্যয়টি আইনগতভাবে বৈধ নয়। অতিরিক্ত ব্যয় হিসেবে ১ কোটি ৯২ লাখ ৫২ হাজার টাকা সেন্ট্রাল ল্যাব পরিচালক প্রফেসর ড. মুহা. আনোয়ারুল হকের নিকট থেকে অর্থ পুনরুদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নিয়ন্ত্রিত ‘ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন (৩য় পর্যায়)-১ম সংশোধিত’ প্রকল্পে ২০২২-২৩ অর্থবছরে লেজার স্ক্যানিং কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ ক্রয়ে ব্যাপক আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) যন্ত্রটি কেনার জন্য ৫০ লাখ টাকা প্রাক্কলন থাকলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সেটি কিনেছে ২ কোটি ৪২ লাখ ৫২ হাজার টাকায়। ফলে প্রকল্প অর্থে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৯২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। জানা যায়, কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরির উল্লিখিত যন্ত্রের পরিবর্তে উন্নত ‘কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ উইথ লাইটনিং সুপার রেজোলিউশন মডিউল’ ক্রয়ের প্রস্তাব দেন ল্যাব পরিচালক। তার দাবি, ডিপিপিতে নির্ধারিত ‘স্পেকট্রাল লেজার স্ক্যানিং কনফোকাল মাইক্রোস্কোপ’ মাত্র ৫০ লাখ টাকায় কিনলে তা গবেষণার জন্য মানসম্মত ও টেকসই হবেনা এবং দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। তাই গবেষণার মান বজায় রাখতে আধুনিক ও উন্নত সংস্করণের যন্ত্রটি কিনতেই ৫০ লাখ টাকার পরিবর্তে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার প্রাক্কলনসহ নতুন স্পেসিফিকেশন পাঠানো হয়। এ বিষয়টি সেন্ট্রাল ল্যাবের পরিচালক ড. মুহা. আনোয়ারুল হক স্বপন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক এইচ এম আলী হাসানকে লিখিত অনুরোধ জানান। কেন্দ্রীয় ল্যাবরেটরির জন্য মোট ৭১টি যন্ত্রপাতি কেনার বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এর মধ্যে লেজার স্ক্যানিং কনফোকাল মাইক্রোস্কোপের জন্য নির্ধারিত ব্যয় ছিল ৫০ লাখ টাকা। কিন্তু ১৮ এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মেসার্স ওভারসিজ মার্কেটিং করপোরেশন প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে ২ কোটি ৪২ লাখ ৫২ হাজার টাকার চুক্তি করে এবং বিল অনুযায়ী সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধও করে। এদিকে ইবির শাহ আজিজুর রহমান হলের প্রভোস্ট থাকাকালীন লাগামহীন দুর্নীতির অভিযোগে প্রফেসর ড. মেহের আলীকে আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি গঠন করে সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. হারুন অর রশিদ আসকারী। দুর্নীতির অভিযোগগুলো হলো- আসবাবপত্র ও বিভিন্ন ভোজ উপলক্ষে কেনা কাটায় দুই লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতে ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর হল অডিটের সময় ধরা পড়ে তার দুর্নীতি। হলের ৩০টি ফ্যান ক্রয় বাবদ ভাউচারে ৯০ হাজার টাকা হলের ফান্ড থেকে উত্তোলন করা হয় প্রভোস্ট প্রফেসর ড. আনোয়ারুল হক স্বপনের স্বাক্ষরে।
কিন্তু একটি ফ্যান ও তিনি ক্রয় করা হয়নি। এছাড়া পৃথক দুটি ভাউচারে ৪০ হাজার টাকা হল ফান্ড থেকে উত্তোলন করা হলেও কোনো ব্যয় দেখানো হয়নি। এছাড়াও হলের আশপাশে জঙ্গল পরিষ্কারের নামে প্রতিনিয়ত টাকা উত্তোলন করা হতো। তদন্ত কমিটি প্রায় ১০ লক্ষাধিক অনিয়মের সত্যতার প্রমাণ পাওয়ায় প্রভোস্ট প্রফেসর ড. মুহা. আনায়ারুল হককে দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তীতে শাস্তি নির্ধারণের জন্য সিন্ডিকেট প্রফেসর ড. শাহজাহান মন্ডলকে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্য প্রফেসর ড. শাহজাহান মন্ডল ও অভিযুক্ত প্রফেসর ড. মুহা. আনোয়ারুল হক স্বপন আওয়ামী বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা হওয়ায় তদন্ত আলোর মুখ দেখেনি। এ বিষয়ে সেন্ট্রাল ল্যাবের সাবেক পরিচালক প্রফেসর ড. মুহা. আনোয়ারুল হক স্বপন বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে অডিট আপত্তি এসেছে, তা আমার জানা নেই। আমি কোনো চিঠিও পাইনি।
এদিকে হলের সরঞ্জাম ক্রয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি মীমাংসিত। সেন্ট্রাল ল্যাবের বর্তমান পরিচালক প্রফেসর ড. জাহিদুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতির অডিট আপত্তি সম্পর্কে জানি না। তবে প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, অভিযোগের বিষয়ে খতিয়ে দেখে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
