কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ঘুষ গ্রহণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সেবাপ্রার্থীর কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে দুই আনসার সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছে। গত সোমবার (২ সেপ্টেম্বর) তাদেরকে ক্লোজ করা হয়। এর আগে রোববার কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ গ্রহণের ঘটনা ঘটে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন ও কুষ্টিয়া জেলা আনসারের কমান্ড্যান্ট রুবায়েত বিন সালাম।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসে একজন সেবাপ্রার্থী পাসপোর্ট করতে গেলে কতর্ব্যরত আনসার সদস্য হেলাল উদ্দিন ও আনিসুর রহমান তাকে দ্রত ফিঙ্গার করিয়ে দেওয়ার কথা বলে ১১০০ টাকা ঘুষ গ্রহণ করেন। ঘুষ গ্রহণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে আরও দেখা যায়, ঘুষ গ্রহণ করার বিষয়টি স্বীকার করে এবং ক্ষমা চান আনসার সদস্য। এসময় ঘুষের টাকা তার কাছে পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।

পরে হেলাল উদ্দিন ও আনিসুর রহমানকে পাসপোর্ট অফিস থেকে ক্লোজ করা হয়েছে। এদিকে কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও কর্তব্যরত আনসার সদস্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই ঘুষ গ্রহণ সহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির  অভিযোগ করেন সেবাপ্রার্থীরা। তাদের অভিযাগ, কারণে অকারণে আনসার সদস্যরা ঘুষ দাবি করে বসেন। তাদের এ ধরনের আচরণে অনেকেই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন। কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতিদিনই কমবেশি বিভিন্ন বয়সী মানুষের আনাগোনা থাকে। তবে সেবা নিতে আসা লোকজনের অভিযোগ, কুষ্টিয়া পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছে সরাসরি গেলে সেবা মেলে না। কিন্তু দালালদের অতিরিক্ত টাকা দিলেই দ্রুত মিলে কাঙ্ক্ষিত পাসপোর্ট পাওয়ার সেবা। আর অতিরিক্ত টাকা না দিলে বা দালাল না ধরলে আবেদন জমা দেওয়া থেকে শুরু করে পাসপোর্ট হাতে পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগ, নিজেরা পাসপোর্টের আবেদন করলে নানাভাবে হয়রানি করা হয়। কিন্তু দালালদের টাকা দিলেই সব কাজ দ্রুত হয়ে যায়। এ জন্য দুই হাজার থেকে চার হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। আবার কখনো দায়িত্বরত আনসার সদস্যরাও সেবাপ্রার্থীদের পাঠিয়ে দেন দালালদের কাছে। আনসার সদস্যরাও ঘুষ গ্রহণ কিরে।

এ সমস্যার সমাধানের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তারা আরও বলেন, পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তির কথা সবারই জানা আছে। এজন্য অনেকেই দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করান। দালালের মাধ্যমে করলে কোনো ভোগান্তি পোহাতে হয় না। তবে বাড়তি দুইতিন হাজার টাকা দিতে হয় দালালকে৷ দালালের মাধ্যমে গেলে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। এক ঘণ্টার মধ্যে আবেদন ও আঙুলের ছাপ দেওয়া হয়ে যায়। দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পাওয়া যায়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ওই টাকার ভাগ পায়। টাকার লোভে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের হয়রানি করে।

এই সমস্যা সমাধানের দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দালাল বলেন, ভোগান্তি এড়াতে এবং দ্রুত নির্বিঘ্নে পাসপোর্ট হাতে পেতে সেবাপ্রার্থীরা দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করেন। প্রতি পাসপোর্টে দুই থেকে চার হাজার পর্যন্ত বাড়তি টাকা নেয়া হয়। সেই টাকার ভাগ পাসপোর্ট অফিসের আরিফের মাধ্যমে রেকর্ড কিপার হাসানুজ্জামান ওরফে হাসানকে এক হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়। সেই টাকার ভাগ সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেনের পকেটেও যায়। এভাবেই দালালচক্রের লোকজন কাজ করে। পাসপোর্ট অফিসের আনসার সদস্যরা দালালদের সহযোগিতা করেন।

বিনিময়ে দালালদের কাছ থেকে তারা টাকা পান। এছাড়াও তারা সরাসরি ঘুষ গ্রহণ করে। এই পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কুষ্টিয়া শহরের বহু কম্পিউটারের দোকানের লোকজন ও প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন দালাল রয়েছে। গ্রাহকদের কাছে থেকে নেওয়া বাড়তি টাকার ভাগ আনসার, অফিস সহকারী, রেকর্ড কিপার হাসান ও সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন নেন। পাসপোর্ট অফিসের সামনের সবগুলো কম্পিউটারের দোকান দালালদের।

তারাই সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বেশি প্রতারণা করেন। পাসপোর্ট করতে আসা কয়েকজন ব্যক্তি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা বেশির ভাগ মানুষ পাসপোর্ট তৈরির কার্যক্রম সম্পর্কে জানেন না। এ সুযোগটিই কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধ দালালচক্র এসব সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে সমানভাবে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে।

এই চক্রের সদস্যরা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। দীর্ঘদিনের এ সমস্যার সমাধান হোক। দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়েছেন তারা। অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য পাসপোর্ট অফিসের রেকর্ড কিপার হাসানুজ্জামান ওরফে হাসানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তাকে পাওয়া যায়নি। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন বলেন, যারা পাসপোর্ট করতে আসেন তারা ভোগান্তি ছাড়াই আমাদের সেবা পেয়ে থাকে।

সরকারি নিয়ম মেনে তাদের সেবা প্রদান করা হয়। আমি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত না। অফিসের কেউ দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদেরর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দুই আনসার সদস্য অনিয়ম করেছিলো। তাদেরকে পাসপোর্ট অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তাদের চাকরি চলে গেছে। আমরা তাদেরকে আনসার বেরাকে পাঠিয়ে দিয়েছি। কুষ্টিয়া জেলা আনসারের কমান্ড্যান্ট রুবায়েত বিন সালাম বলেন, কুষ্টিয়া আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের দুজন আনসার সদস্যকে সরিয়ে নিয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Leave a Comment