আর এইচ কনক ॥ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর নির্দেশনায় গত (২৯ জুন) ২০২৪ সালের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষা উপলক্ষে দেশের সব কোচিং সেন্টার ৪৪ দিনের জন্য বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করলেও মানছেন না কুষ্টিয়ার অধিকাংশ একাডেমিক কোচিং সেন্টার গুলো।
মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ২৯জুন থেকে আগামী ১১ আগস্ট পর্যন্ত (৪৪ দিন) বন্ধ থাকবে দেশের সকল কোচিং সেন্টার। কিন্তু কুষ্টিয়ার চিত্র সম্পূর্ণই ভিন্ন, কোচিং বন্ধের নির্দেশ থাকলেও বহাল তবিয়তে চলছে একাডেমিক কোচিং সেন্টার গুলো। দীর্ঘ ৪৪ দিন বন্ধ থাকলে কোচিং সেন্টারগুলো প্রায় ২ মাসের অর্থ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই সরকারি নির্দেশকে উপেক্ষা করেই চালিয়ে যাচ্ছে টুকিটাকি পাঠ্য দান কার্যক্রম। এমনি এক কোচিং সেন্টারে পড়ুয়া শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া মিম জানান, গত ২৯ তারিখে কোচিং সেন্টার বন্ধের কথা থাকলেও তা বন্ধ করা হয় নি, কোচিং থেকে আমাদেরকে বলা হয়েছে আগের মতই প্রতিদিন ক্লাস চলবে । তাই আমরাও কোচিং সেন্টারে আসছি, কিন্তু কোচিংয়ের শিক্ষকরা আমাদের ক্লাস সেইভাবে নিচ্ছে না। বসে থেকে এক ঘন্টা সময় পার করে আবার বাসায় ফিরছি। তাহলে বোঝা গেল যে, এইসব কোচিং সেন্টার গুলো মূলত শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশে সহায়তা নয় বরং তাদের বাণিজ্য নিয়ে ব্যাতি ব্যস্ত। বিশেষ করে স্কুল কলেজে চাকুরীরত শিক্ষক শিক্ষিকারা এই পেশায় জড়িয়ে পড়ে আরোও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। বাংলাদেশ সরকার শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার নীতিমালা বাস্তবায়নে চুড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করে ২০১২ সাল থেকে । উক্ত সালে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালাটি প্রণীত হলেও সেটা বিভিন্ন আইনি জটিলতায় বাস্তবায়ন করা হয় ২০১৯ সালে।
মূলত কোচিং সেন্টার গুলো শিক্ষার্থীদের সহায়ক না হয়ে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিচালনা করা হয়ে থাকে। যার মূল কারণ এক শ্রেণীর অর্থ লোভী শিক্ষক। স্কুল কলেজের শিক্ষকতা করার পাশাপাশি অধিক অর্থ উপার্জনের লালসায় এক শ্রেণীর শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের কোচিং করার জন্য কৌশলগতভাবে বাধ্য করেন। শিক্ষকরা শ্রেণীতে সঠিক ভাবে পাঠ্য দান করলে কোন শিক্ষার্থীরই আলাদা করে কোচিং ও প্রাইভেট পড়া লাগে না। কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থাও চিকিৎসকদের মত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে রোগীর যেমন প্রপার ট্রিটমেন্ট হয় না, একইভাবে স্কুল কলেজের শিক্ষকদের শ্রেণীতে পাঠ্য দানের উপর নির্ভর করলে, শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল করতে পারে না। এই অসুস্থ শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য একমাত্র দায়ী কোচিং বাণিজ্য। শিক্ষার্থীদের মাথা এমন ভাবে ধোলায় করা হয়েছে যে, মেধাবী থেকে দুর্বল শিক্ষার্থীরা সবাই স্কুল কলেজের থেকে কোচিং প্রাইভেট এ বেশি প্রাধান্য দেয়।
এইভাবে দিন দিন বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি। স্কুল কলেজের অধ্যয়নের বদলে ছাত্র ছাত্রীরা কোচিং নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছে।
সচেতন মহল এটাকে শিক্ষকদের বাণিজ্যিক মন মানুষিকতা ও উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন।
বার বার শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছে। সম্প্রতি সেই জটিলতা আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠেছে । ২০১৯ সালে সরকার কোচিং সেন্টারগুলো নজরদারির আওতাধীন রাখবার নির্দেশ দিয়ে থাকলেও এখন আর এই বিষয়ে কর্তপক্ষের কোন মাথা ব্যাথা নেয়। কোচিং সেন্টারগুলোয় যাতে একটা শৃঙ্খলা আসে এবং সেটি শুধুমাত্র কোচিং হিসাবেই, অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্যই ব্যবহৃত হয়, বাণিজ্য হিসাবে ব্যবহৃত না হয়, সেই ধরণের একটা চেষ্টা সরকার অনেকদিন ধরেই করে আসছে। আবার একই সময় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা অনেক সময় সেখানে উপকৃত হয়, আবার অনেক সময় অভিযোগ আসে যে, এই কোচিং সেন্টারগুলোতে শিক্ষার্থীদের কোচিং করতে বাধ্য করা হয়, প্রশ্ন ফাঁস হয় ইত্যাদি অভিযোগ পাওয়া যায় । এ কারণেই সরকার চেয়েছিলো যে, এখানে একটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে, সরকার কর্তৃক কোচিং সেন্টারগুলোর মনিটরিং ও নীতিমালা বাস্তবায়নে বিভাগীয় পর্যায়ে একটি, জেলা পর্যায়ে একটি ও উপজেলা পর্যায়ে একটি মোট তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল সে সময়।
এছাড়াও কোচিং সেন্টারগুলোকে স্থানীয় সরকারের আওতায় নিবন্ধিত হতে হবে বলেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।
সে সময়ের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলছিলেন, একজন শিক্ষার্থী কেন কোচিং সেন্টারে যান, সেটাও আমাদের দেখতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষায় কোন ঘাটতি আছে কিনা, পাঠ্যপুস্তকে সমস্যা আছে কিনা, কেন গাইড বইয়ে শিক্ষার্থীদের নির্ভর করতে হয়, ইত্যাদি বিষয়গুলোও তারা তদারকি করবেন।
শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধে গতবছর ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ সালে নীতিমালাটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়।
নীতিমালায় সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদরাসার কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না বলা রয়েছে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ১০জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন।
তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না। সরকারি বা এমপিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এসব নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য অবৈধ বলে গত ২০১৯ এর ৭ এ ফেব্র“য়ারি রায় দিয়েছিলো হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২কে বৈধ বলে রায় কার্যকর করা হয়েছিলো। এই নীতিমালার বাইরে গিয়ে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কেউ শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন না।
নীতিমালাটিতে সরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কোচিং অবৈধ শিক্ষা ব্যবস্থায় কোচিং নির্ভরতা কেন এ পর্যায়ে পৌঁছেছে? কোচিং সেন্টার বন্ধ রেখে প্রশ্ন ফাঁস কি বন্ধ হবে? বিষয়গুলো পর্যালোচনায় উঠে এসেছিলো ।
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ কুষ্টিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা সরকারি কর্তৃপক্ষকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, সরকারের নির্দেশনা কে উপেক্ষা করে যে সমস্ত অর্থলোভীরা কোচিং সেন্টার বন্ধ না রেখে এখনো চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। প্রয়োজনে এ সমস্ত কোচিং সেন্টার গুলোকে অবৈধ ঘোষণা করে বন্ধ করে দেওয়া হোক।
