কনক হোসেন ॥ কুষ্টিয়ার আইলচারা ইউনিয়নের বল্লভপুর এলাকায় তিন ফসলের কৃষি জমিতে গড়ে উঠেছে অবৈধ অটো রাইস মিল। প্রগতি এগ্রো ফুডের স্বত্বাধিকার হাজী জামশেদ আলী কোন নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কৃষি জমিতে গড়ে তুলেছেন তার শিল্প প্রতিষ্ঠান। একদিকে যেমন কৃষি জমি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় অন্যদিকে মিলের চারপাশ ঘেরা ধানী ফসল সহ অন্যান্য ফসল ধ্বংসের যথেষ্ট সম্ভাবনা। কারখানার বজ্রসহ অন্যান্য ময়লা আবর্জনা এবং উত্তপ্ত পানি সবকিছুই ক্ষতি করছে কৃষি ফসলের। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করেই কুষ্টিয়ার খাজনগর সহ আইলচারা ইউনিয়নের কৃষি জমিতে একের পর এক গড়ে তোলা হচ্ছে অটো রাইস মিল। এতে ক্রমেই কমছে কৃষি জমি, ফলে উৎপাদন কমছে কৃষিপণ্যের। আবাদি বা ফসলি জমিতে কোনো শিল্প কারখানা গড়ে তোলা যাবে না এমনই নিদের্শনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সরকারি এ নিদের্শনার মাঝেই কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আইলচারা ইউনিয়নের বল্লভপুর জামে মসজিদ পার হয়ে খোলা মাঠে আবাদি জমি ক্রয় করে গড়ে তোলা হয়েছে প্রগতি এগ্রো ফুড (ইউনিট-২)। যা প্রগতি এগ্রো ফুডের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এ শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ফলে দেয়ানা মৌজায় কয়েক বিঘা আবাদি জমির ক্ষতি হচ্ছে যা স্থানীয় জনজীবনের উপর প্রভাব ফেলছে।

উক্ত এলাকার বাসিন্দারা বলেন, যে জমিতে অটো রাইস মিল গড়ে তোলা হয়েছে সেখানে বছরে তিনবার ধান ও অন্যান্য ফসল হতো। এ মিল তৈরির ফলে ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। তারা আরো বলেন, কৃষি জমিতে রাইস মিল গড়ে তোলার কারণে এখানে আর চাষাবাদ করার কোনো উপায় থাকবে না। ধীরে ধীরে এই মিলের মালিকেরা আশপাশের সকল জমি ক্রয় করে ফেলবে, ফলে আমাদের কৃষিজাত ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে না। এ মিল তৈরির ফলে সাধারণ মানুষের কোনো উপকার নেই বরং চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তাছাড়া এ মিল তৈরির ফলে পাশে বসবাসকারী মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। মিলের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদে খালে। যেখান থেকে কৃষকরা ফসলের জমিতে সেচের পানি সরবরাহ করতো। নষ্ট হবে এ খালের পানি ও জীববৈচিত্র্য। মিলের আশেপাশের জমির মালিকরা বলেন, মিল তৈরির ফলে আমরা চরম ক্ষতির মুখে পড়ব। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠবে। বাতাসে ধূলা ছড়াবে। হয়তো বা আমরা আর এখানে চাষাবাদ করতে পারব না। মিলের মালিকেরা আস্তে আস্তে সব জায়গা কিনে নেবে। মিলের চারপাশের জমির মালিকরা কেউই খুশি নয় এ মিলটি করা নিয়ে। তারা বলছেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন এ মিলটি গড়ে উঠলে এলাকার পরিবেশ নষ্ট হবে। এক পর্যায়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে পড়বে এই প্রান্তর।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রত্যেক জেলা প্রশাসককে নির্দেশনা দিয়েছেন কৃষি জমিতে আর কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান যেন গড়ে না ওঠে, সে দিকে নজর রাখতে। উক্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষ কৃষি নির্ভর। প্রগতি এগ্রো ফুড লিমিটেডের বিরুদ্ধে ধান আবাদি কৃষি জমি ভরাট ও ইন্ডাস্ট্রি নির্মাণের মাধ্যমে কৌশলে জমির শ্রেণি পরিবর্তন করার অভিযোগ রয়েছে । কৃষি জমি সুরক্ষা, ভূমি ব্যবহার আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন না মেনে কৃষি জমি ভরাট করে ইন্ডাস্ট্রি ও শিল্প-কারখানা নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেছে। অপরিকল্পিতভাবে এসব স্থাপনা নির্মাণ চলতে থাকলে কমবে ফসলি জমি এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকেরা। কীভাবে ধান আবাদি কৃষি জমির শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে, সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ভূমি অফিসসহ সরকারি কোনো দপ্তরের কর্মকর্তারা এই অনিয়মে জড়িত আছেন কিনা, কৃষি জমিতে ইন্ডাস্ট্রি ও মিল-কারখানা স্থাপন-নির্মাণে পরিবেশগত ছাড়পত্র আছে কিনা, তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানান কৃষকেরা। সমাজের সুশীল ব্যক্তিগণ বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা রয়েছে। কৃষি জমিকে ব্যবহার করে অপরিকল্পিতভাবে শিল্পায়ন করা যাবে না। শিল্পজোন গঠন করেই শিল্প কল কারখানা করা উচিত। আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার কারণে কৃষি জমিতে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে বলে মনে করেন তারা। কিন্তু সূত্রমতে, কৃষিজমি সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে কৃষিজমি সুরক্ষা করার বিষয়টি আইনের খসড়ায় উল্লেখ রয়েছে। কোনোভাবেই জমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। কৃষিজমি নষ্ট করে আবাসন, শিল্প-কারখানা, ইটভাটা বা অন্য কোনো অকৃষি স্থাপনা নির্মাণের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কৃষিজমি যে কেউ ক্রয়-বিক্রয় করতে পারলেও তা আবশ্যিকভাবে শুধু কৃষিকাজেই ব্যবহার করতে হবে। এসব নির্দেশনা যেন নিছক গল্প আকারে মানায় খাজা নগরের এই বৃহৎ ব্যবসায়ী হাজী জামশেদ আলীর কাছে।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রগতি এগ্রো ফুড (ইউনিট-২) স্বত্বাধিকার হাজী জামশেদ আলী ধানী জমিতে কারখানা করা যায় না স্বীকার করে বলেন, এটা সরকার জানে। সরকার দেখবে বিষয়টি। আপনি যা খুশি লেখেন।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জানান, আনুমতি না নিয়ে কৃষি জমিতে অটো রাইস মিল করা হলে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আতাউর রহমান দক্ষিন কোরিয়ায় প্রেষণে উচ্চশিক্ষারত থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বরত সিনিয়ন কেমিস্ট মো. হাবিবুল বাসার বলেন, অনুমতি নিয়েছে কিনা অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তবে অনুমতি না নিয়ে কৃষি জমিতে অটো রাইস মিল করা হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সচেতন মহলের দাবি উক্ত বিষয়ে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে সর্বোচ্চ আইনের প্রয়োগ করে এ সমস্ত অবৈধ অটো রাইস মিলকে উৎখাত না করা গেলে কৃষিসহ কৃষকরা বিলুপ্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য কৃষি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার যে বদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
