আশিক ইসলাম ॥ গ্রাম অথবা শহর। খেলা পছন্দ করেন না এমন মানুষ দেশে খুজে পাওয়া দায়। যুব সমাজের কথা বলারই অবকাশ নেই। বিশেষ করে স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা তো দেশ বিদেশের নানান খেলোয়াড় আর দলকে নিয়ে রীতিমত আলোচনা-সমালোচনার পশরা নিয়ে বসে। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে খেলার আসক্তিকে বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন। কিন্তু খেলা দেখা যেন এখন আর শুধু খেলা দেখাই নয়, সঙ্গে বাজি ধরার একটি সহজ প্লাটফর্ম। চাইলে খেলা দেখতে দেখতেই কেউ একটা ম্যাচ বা ম্যাচের কোনো অংশ নিয়ে বাজি ধরে ফেলতে পারেন। বাজি মানে জুয়া বা বেটিং। অনলাইন জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীসহ তরুণ সমাজের একটি বড় অংশ। জুয়ার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে শ্রমজীবি মানুষের মধ্যেও। সর্বস্ব খুইয়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ। বাড়িছাড়া অনেকে। জুয়ার নেশা অশান্তি-কলহের পাশাপাশি অনেক পরিবারকে বিপন্ন করে তুলছে বলে ভুক্তভোগিরা জানিয়েছেন।

তবে এসব অনলাইন জুয়া আইন করে দেশে নিষিদ্ধ করা হলেও এ বিষয়ে আইনশৃংখলা বাহিনীর তৎপতা নেই বললেই চলে। ফলে কোন রকম ঝুটঝামেলা ছাড়ায় তরুণরা বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসেই জুয়া চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের তারকা খেলোয়াড়রা বেটিং-এর বিজ্ঞাপনে থাকায় তরুণদের আরো আকৃষ্ট করছে। অবিলম্বে এ ধরনের সাইটগুলো বন্ধ করা না হলে পারিবারিক অশান্তিসহ সামাজিক বিশৃংখলা বৃদ্ধির আশংকা রয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লোভনীয় অফারের নানা ভিডিও এবং বুস্ট করা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অধিকাংশ জুয়া বা বেটিং সাইটগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। এসব সাইটে বুঝে না বুঝে একটি মাত্র ক্লিকে অ্যাপস কিংবা ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে শুরুতে সদস্য টানতে অবলম্বন করা হচ্ছে কৌশল। অল্প টাকায় লাখপতি হওয়া বা দ্বিগুণ মুনাফার লোভে অন্ধকার এ জগতে পা বাড়াচ্ছে মানুষ। একসময় লোভে পড়ে অতিরিক্ত অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা। তখনই বেরিয়ে আসে আসল রূপ। মোটা অঙ্কের টাকা মুহূর্তেই হারিয়ে যায় জুয়ার বোর্ডে। শুর হয় আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতি। দৌলতপুর উপজেলায় কয়েক হাজার মানুষ বেটিং বা অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত। যাদের অধিকাংশই স্কুল কলেজে পড়ুয়া ও বয়সে তরুন। পিছিয়ে নেই কর্মজীবিরাও। জুয়ার টাকা জোগাতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন এসব তারা। যত দিন যাচ্ছে জুয়ায় আসক্তের সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আকর্ষনীয় অফার ও চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে যারা জুয়ায় বাজি ধরেছেন তাদের খুব কম সংখ্যাকই এই আসক্তি থেকে বেরিয়ে এসছেন। প্রতিদিন এ উপজেলায় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে এসব অনলাইন জুয়ায়। উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই অনলাইন বেটিং ছড়িয়ে পড়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আইপিএল থেকে শুরু করে প্রায় সব ম্যাচেই জুয়ার আসর বসছে। একজন ব্যাটসম্যান ব্যাট করছেন, তিনি কত রানে আউট হবেন, কারও সেটা নিয়ে বাজি ধরার ইচ্ছা হলো। কোনো সমস্যা নেই। স্ক্রীনে ভেসে উঠছে একাধিক জুয়ার সাইট। অনলাইন বেটিং করার জন্য দেশি-বিদেশি অনেক অ্যাপস ও সাইট রয়েছে। ওইসব সাইটগুলোতে ব্যাটসম্যানের রানের উপর জুয়ার রেট দেখানো হচ্ছে। এসব অ্যাপস মোবাইল বা কম্পিউটারে ইন্সটল করার পর সেখানে রেজিষ্ট্রেশন বা অ্যাকাউন্ট খুলে ঘুর বসেই খেলতে পারছেন অনলাইন জুয়া। একাধিক অনলাইন বেটিং বা জুয়ার অ্যাপসে প্রবেশ করে দেখা যায়, অ্যাপসগুলো বিভিন্ন ইভেন্টে আকর্ষণীয় অফার সম্বলিত জুয়ার পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছে। কোন টিম কত রান করবে, কোন টিম জয়ী হবে, কোন খেলোয়ার কত রান বা উইকেট পাবে, কোন ওভারে কত রান হবে এমন বহু আইটেম। কোন আইটেমের জন্য কত টাকা রেট তাও উলেল্লখ করা রয়েছে। নিজ নিজ পছন্দের ইভেন্টে জুয়া ধরতে পারেন। জুয়ায় ধরার জন্য প্রথমে মোবাইল ব্যাকিং এর মাধ্যমে অ্যাপসের অ্যাকাউন্টে টাকা লোড করা হয়। পরে ওই অ্যাকাউন্ট থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ জুয়ায় লগ্নি করেন তারা। হেরে গেলে টাকা চলে গেল। আর জিতলে মুল টাকাসহ জুয়ার রেটের টাকা আবার অ্যাকাউন্টে ফিরে আসে। পরে সেখান থেকে ফের মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করা হয়। কোন কোন সময় স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমেও জুয়ার টাকা লেদদেন করা হয়। কোন জটিলতা ছাড়া টাকার লেনদেন ও আকর্ষনীয় অফারের ফলে প্রতিদিন এর প্রতি আসক্তির পরিমান বাড়ছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মোবাইলে খেলা দেখার নাম করে জুয়ায় আসক্তদের নিয়ে চরম অশান্তিতে রয়েছে পরিবারগুলো। জুয়ার টাকা যোগাতে পরিবারের নাম ভাঙ্গিয়ে জুয়াড়ি সন্তানরা আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকাবাসীর কাছ থেকে ধার-কর্য করে টাকা নিয়ে জুয়ায় বাজি ধরছে। পরে ধার-কর্য়ের এসব টাকা পরিশোধ করা নিয়ে পরিবারকে সামাজিক হেনস্তার মুখে পড়তে হচ্ছে। এমনবি টাকার যোগান দিতে পরিবার ও স্বজনদের বাড়িতে চুরির ঘটনাও ঘটাচ্ছে জুয়ায় আসক্তরা। জুয়ায় সবাই হেরেই যাচ্ছে তা নয়। অনেকে জুয়া জিতে হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছের মত হয়েছে। তবে জুয়ায় জিতে টাকা ওয়ালা হয়েছে এমন সংখ্যা হাতে গোনা দু’একজন। স্বর্বস্ব খোয়ানোর সংখ্যাই বেশি। অনলাইন বেটিং-এ আশক্ত উপজেলার আল্লারদর্গা এলাকার বাসিন্দা কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী অনিক জানায়, খেলা দেখার সময় অনলাইন বেটিং এর বিজ্ঞাপন দেখে অনলঅইন বেটিং-এ আগহী হোয়। সেখানে বাজির অফার দেখে পুরো বিষয়টি আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়। ধীরে ধীরে সেখানে টাকা বাজি ধরি। কখনও লাভ কখনও লস হয়। একপর্যায়ে চরম আশক্ত হয়ে পড়ি। পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাত জেগে বাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে গোপনে টাকা নিয়ে জুয়ায় বাজি ধরি। প্রায় তিন লক্ষ টাকা জুয়ায় হেরেছি। বিষয়টি জানাজানি হলে পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। উপজেলার নলুয়া গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ২১ বছর বয়সী তার নাতি অনলাইন জুয়ায় আসক্ত। নিজের বাড়ি থেকে জুয়ার টাকা যোগাতে না পেরে গত সপ্তাহে সে তার চাচার ঘর থেকে ২০ হাজার গোপনে নিয়ে যায়। পরে ১৫ হাজার টাকা তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। বাকি টাকা অনলাইনে হেরেছে বলে জানায়। অনলাইন বেটিং-এ আশক্ত তারাগুনিয়া গ্রামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সোহেল রানা বলেন, ‘আমি একটি ছোট ব্যবসা করে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টাকার মত আয় হয়। ছেলে মেয়ে ভালোই চলছিল। অন্যের পরামর্শে আমিও অনলাইন বেটিং-এ আশক্ত হয়ে পড়ি। ব্যবসার পুরো মুলধন (প্রায় ২ লক্ষ টাকা) খুয়েছি। ওই টাকা ফেরাতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাক্তি ও এনজিওর নিকট থেকে প্রায় এক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে তার হেরেছি। এখন আমি নিঃস্ব। এ বিষয় নিয়ে পারিবারিক অশান্তিতে থাকা মথুরাপুর গ্রামের ওমর ফারুক বলেন, তার একটি মাত্র ছেলে কলেজে পড়ে। প্রায়ই সে মোবাইলে খেলা দেখে। পরে জানা গেল অনলাইনে সে শুধু খেলা দেখে না, জুয়াও খেলে। প্রথমে গোপনে সে পরিবারের জমানো টাকা চুরি করে নিয়ে জুয়ায় লগ্নি করে। পরে আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও গ্রামের মানুষের কাছ থেকে সুদের উপর টাকা নিয়েও অনলাইনে খুয়েছে। টাকা ফেরত না পেয়ে এখন পাওনাদাররা বাড়িতে এসে ঝামেলা করছে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে চরম অশান্তি তৈরী হয়েছে। উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ও পিপল্স ডিগ্রী কলেজের উপাধ্যক্ষ আবু সাঈদ মোঃ আজমল হোসেন বলেন, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে এগুলো মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়বে।স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়াও গ্রামাঞ্চলের একেবারে নিম্নপর্যায়ের ব্যক্তিরাও এতে জড়িয়ে পড়ছেন। দ্রুত এসব সাইটগুলো বন্ধ করা দরকার। তা না হলে সামাজিক অস্থিতা সৃষ্টি হবে। কুষ্টিয়া জেলা সাইবার অপরাধ ইউনিটের ওসি ওবাইদুর রহমান বলেন, কাউকে মোবাইলে হুমকি-ধামকি, প্রতারণা, লোকেশন ট্র্যাকিংসহ বেশ কিছু কাজ কুষ্টিয়া পুলিশের সাইবার ইউনিট করে থাকে। অনলাইনে কারা এসব বেটিং বা জুয়ার সাথে জড়িত তা সনাক্ত এবং সাইটগুলো বন্ধ করার সক্ষমতা আমাদের নেই। এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়।
