বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সাংবাদিকের রক্তে ভেজা জনপদ কুষ্টিয়া। গেলো ১৬ বছর গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য কেটেছে এক ভীতিকর সময়। তখনকার সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতো সাংবাদিকরা। ফ্যাসিবাদি দলটির কেউ সামান্যতম সমালোচনাও সহ্য করতো না। হামলা-মামলার ভয়ে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাদাবাজি, টেন্ডারবাজির বিরুদ্ধে কেউ কলম ধরার সাহসও করতো না। সামান্যতম অনিয়ম নিয়ে কেউ সংবাদ প্রকাশের চেষ্টা করলেই তার ওপর হামলা নয়তো মামলা দেয়া হতো। এমনকি সাংবাদিককে হত্যা করে মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আদালত চত্ত্বরে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকার সম্পাদককে হত্যার উদ্দেশে হামলা চালিয়ে গুরুত্বর রক্তাক্ত জখম করা হয়েছে। আর এসবই হয়েছে আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে।
আওয়ামী ক্যাডারদের ভয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিক কুষ্টিয়াও ছেড়েছেন। ১৬ বছরে সাংবাদিকদের ওপর যত হামলা-মামলা: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক জুলুম-নির্যাতন নেমে আসে। ভূক্তভোগী গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, গত ১৬ বছরে আওয়ামী শাসন কালে হানিফ ও তার অনুসারীদের রোষানলে পড়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন অন্তত দুই ডজন গণমাধ্যমকর্মী। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল ক্ষমতায় আসার পর কুষ্টিয়ার দুই সংসদ সদস্যের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় প্রথম মামলা হয় সমকাল প্রতিনিধি সাজ্জাদ রানার বিরুদ্ধে। পরবর্তিতে হানিফ ও তার ভাই আতার বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিবেদন করায় তার অনুগত স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লবকে দিয়ে থানায় একাধিক অভিযোগ করান।
থানায় ওসির রুমে বিপ্লব তার ক্যাডার বাহিনী নিয়ে হামলা করেন সাজ্জাদ রানার উপর। এর কয়েক বছর পর থানাপাড়া এলাকায় টেন্ডার সংক্রান্ত বিষয় সংবাদ করায় একুশে টিভির প্রতিনিধি জহুরুল ইসলামের ওপর হামলা হয়। এছাড়াও হানিফের দোসরদের দায়ের করা মামলায় কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মী এখনও সাইবার ট্রাইব্যুনালে হাজিরা দেন। তারা হলেন, বাংলাভিশনের হাসান আলী, যমুনা টেলিভিশনের (বর্তমানে রাজশাহীতে সময় টেলিভিশনে কর্মরত) মওদুদ রানা, স্থানীয় সাংবাদিক আসলাম আলি, মুন্সি শাহিন আহমেদ জুয়েল ও অঞ্জন শুভ। তাদের অধিকাংশই জেলে গেছেন। হয়রানির মুখে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে কুষ্টিয়া ছেড়ে রাজশাহী চলে যান সাংবাদিক মওদুদ রানা। ফ্যাসিস্ট হানিফের অন্যতম ক্যাশিয়ার জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলামের অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করায় জেলে গেছেন,
স্থানীয় দিনের খবর পত্রিকার সাংবাদিক ও বর্তমানে দৈনিক যুগান্তর প্রতিনিধি এএম জুবায়েদ রিপন এবং স্থানীয় মাটিরডাক পত্রিকার সম্পাদক লুৎফর রহমান কুমার। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে সন্তুষ্ট করতে মাহবুবুল আলম হানিফ কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি ইয়াছির আরাফাত তুষারকে দিয়ে আমার দেশ পত্রিকার মজলুম সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করায়। ২০১৮ সালে ২২ জুলাই ওই মামলায় হাজিরা দিতে আসলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে হানিফ তার ক্যাডারদের দিয়ে প্রকাশ্য আদালতে চত্ত্বরে হত্যার উদ্দেশে ড. মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা চালায় সন্ত্রাসী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা কর্মিরা। আর তাদের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আওয়ামীলীগ নেতা ও কথিত সাংবাদিক নেতা রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব।
আমার দেশ সম্পাদক গুরুত্বর রক্তাক্ত জখম হলেও তাঁর সাহায্যে পুলিশ এগিয়ে না এসে উল্টো হামলাকারীদের সহায়তা করে। হানিফ আগের দিন রাতে নেতাকর্মিদের মজলুম সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানকে হত্যার নির্দেশ দেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক যুবলীগ নেতা জানিয়েছেন। হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ১০ অক্টোবর আমার দেশ সম্পাদক এ বিষয়ে থানায় মামলা করেন। অথচ এ মামলায় আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও একজন আসামিও গ্রেফতার হয়নি। আমার দেশ সম্পাদকের দায়ের করা মামলার অগ্রগতি জানতে গত শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) রাত ৯টায় কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমানের মোবাইলে একাধিক বার ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি। পরে মোবাইলে পরিচয় দিয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তার উত্তর দেননি পুলিশ সুপার। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের দূর্নীতি নিয়ে নিউজ করায় স্থানীয় সাংবাদিক মুন্সি শাহিন আহমেদ জুয়েল ও অঞ্জন শুভর নামে মামলা দেয়া হয়। হানিফের স্বার্থে আঘাত করায় তাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন ভিন্ন তিনটি মামলা দেয়া হয়।
এছাড়া হানিফের পরিচিত জনের অপকর্ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় মুন্সী শাহীন আহমেদ জুয়েল ও গ্লোবাল টিভির কুষ্টিয়া প্রতিনিধি সনি আজিম এখনো হাজিরা দিচ্ছেন খুলনার সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে কুষ্টিয়ায় সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটলেও বিচার হয়নি কোনো ঘটনার। ২০২৩ সালে ২০ অক্টোবর কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন ছয় সাংবাদিক। এসময় তাদের স্পিড বোট থেকে হত্যার উদ্দেশ্যে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে বালু উত্তোলনকারী আওয়ামীলীগ নেতা হান্নান মন্ডলের পোষা সন্ত্রাসীরা।
সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নের ভবানীপুর এলাকায় পদ্মা নদীতে এ ঘটনা ঘটে। ২০২৩ সালের ০৪ নভেম্বর দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নিজ বাড়িতে ঢোকার সময় হামলা শিকার হন ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদের দৌলতপুর উপজেলা প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম সোহাগ। দৌলতপুরের তৎকালীন সংসদ সদস্যের পিএস এর দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহের পর দিনই হামলার শিকার হন তিনি। জানা গেছে, মাহবুবউল আলম হানিফের ইশারায় তার অনুগতরা সাংবাদিকদের দমন করতে মামলাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে বারবার। এমনকি হানিফের তোষামোদকারী কতিপয় সাংবাদিক নামধারী দলীয় ক্যাডারকে দিয়ে মিডিয়ার মালিক ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করানো থেকে শুরু করে পত্রিকা অফিসে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করা ও মিথ্যা মামলা দেওয়ার নজিরও আছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলা অথবা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশও সহায়তা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকরা বলছেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতা, শেখ হাসিনার বেয়াই মাহবুবউল আলম হানিফ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ভয়ে জেলার গণমাধ্যমকর্মীরা সব সময় তটস্থ থাকতেন।
এ ব্যাপারে নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক হাসান আলী বলেন, বিগত আওয়ামী সরকার ও দলটির নেতা এবং পুলিশের বিভিন্ন দুর্নীতি- অপকর্মের নিউজ ও অপকর্মের খোঁজখবর নেয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে অন্যজনকে দিয়ে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করায় এবং আমাদের কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি আরো বলেন, এই সরকারের কাছে আমাদের দাবি নিঃস্বার্থভাবে এই মামলা প্রত্যাহার করা হোক। ১৭ সাল থেকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও খুলনার সাইবার ট্রাইব্যুনালে ঘুরতে-ঘুরতে আমরা ক্লান্ত। একই সাথে সরকারের কাছে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সুষ্ঠু কর্মক্ষেত্র তৈরির দাবী করেন তিনি।
সাংবাদিক মুন্সী শাহিন আহমেদ জুয়েল বলেন, কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজের দূর্নীতির নিয়ে তদন্ত কমিটির রির্পোটের ভিত্তিতে আমার সম্পাদনায় পরিচালিত “ভয়েজ অফ কুষ্টিয়া” নামের নিউজ পোর্টালে নিউজ করি। ওই নিউজ করার পর মাহবুব আলম হানিফ ও তার তার ভাই আতার রোষাণলে পড়ি আমরা। সম্ভবত ২০২১ সালের করোনা কালে এই নিউজ প্রকাশিত হয়। তদন্ত শেষে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি ১২ বিষয়ে অনিয়ম চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। বিভিন্নভাবে তিনটি মামলা হয় আমাদের বিরুদ্ধে। একটি মামলায় আমরা দু’জন ২১ দিন কারাগারে ছিলাম। পরে হানিফ ঘনিষ্ঠ বণ্যা খাতুন আয়াত এর বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকান্ড নিউজ করি। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হানিফ কথিত সাংবাদিক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লবের মাধ্যমে আমার (জুয়েল) ও সাংবাদিক সনি আযমের বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করায়। ওই মামলায় এখনো খুলনার সাইবার ট্রাইবুনাল আদালতে হাজিরা দিচ্ছি আমরা । তিনি আরো বলেন, ফ্যাসিস্টের পতনের পর এই সরকার সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে বলে আমরা আশা করি।
সাংবাদিক হত্যা: ২০২২ সালের ৩ জুলাই রাত ৯টার দিকে কুষ্টিয়া শহরের সিঙ্গার মোড় এলাকা থেকে নিখোঁজ হন সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল। এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি করে তার পরিবার। পরে ৭ জুলাই দুপুরে কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া এলাকায় নির্মাণাধীন শহীদ গোলাম কিবরিয়া সেতুর নিচে গড়াই নদী থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রুবেলের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁর পড়নের জামা-কাপড় ও মানিব্যাগে থাকা পরিচয়পত্র দেখে লাশ শনাক্ত করে পরিবারের লোকজন। ৮ জুলাই রুবেলের দাফন শেষে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে কুমারখালী থানায় মামলা দায়ের করেন রুবেলের চাচা মিজানুর রহমান বাদী হয়ে। মামলাটি আজো পুলিশের খাতায় ক্ললেস! তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হানিফের ঘনিষ্ঠ এক ঠিকাদারের অনিয়ম-দূর্নীতির তথ্য জেনে যাওয়ায় সংবাদ প্রকাশের আগেই রুবেলকে হত্যা করা হয়। আর এই হত্যাকান্ডের সাথে তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য জড়িত বলেও অভিযোগ। সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল কুষ্টিয়া জেলা রিপোর্টার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, স্থানীয় দৈনিক কুষ্টিয়ার খবর পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও দৈনিক আমাদের নতুন সময় পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
আলোচিত ওই হত্যা মামলার বিষয়ে শুক্রবার (২৭ ডিসেম্বর) রাতে তাঁর চাচা মিজানুর রহমান জানান, দীর্ঘদিনেও মামলাটির কোন অগ্রগতি হয়নি। রুবেল হত্যার সাথে কুষ্টিয়ার তৎকালীন সরকারি দলের অনেক বড় নেতা জড়িত। সরকার বদলেও আতঙ্কের কারণে সেটা এখনও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। দ্রুত আসামীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে বর্তমান সরকারের কাছে দাবী জানান তিনি। নাটের গুরু হানিফ : ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ মুখে মিডিয়ার স্বাধীনতার কথা বললেও শুরু থেকেই কুষ্টিয়ার সাংবাদিকদের টুটি চেপে ধরেছিলেন। উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়ম ও দলীয় কোন নেতার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করলেই অনুগতদের দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে জেলে ভরার ব্যবস্থা করতেন তিনি। এমনকি সাংবাদিকদের বাসা থেকে ধরে নিয়ে থানায় আটকে রেখে মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন এই নেতা। কেউ কেউ নির্যাতনের ভয়ে তার বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতেন। তার প্রশংসা করে বক্তব্য রাখতেন। তার ও তার অনুগতদের বিরুদ্ধে নিউজ প্রকাশ করলেই জামায়াত-বিএনপি তমকা দিয়ে তাকে হয়রানি করা হতো। এমন ঘটনা অহরহ ঘটেছে। হানিফ দলবাজ সাংবাদিকদের সাথে নিয়ে চলতেন। এর বাইরে অন্য সাংবাদিকদের শত্রু হিসেবে মনে করতেন। তাই প্রতিটি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনার সাথে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদ আছে বলে ভূক্তভোগী গণমাধ্যমকর্মীদের অভিযোগ।
