কুমারখালী প্রতিনিধি ॥ তোর টাহা দরকার কতি, আরো দিতাম। বাপ না দেয় আমি গরু বেচে দিতাম। তুই আমার কতিক। গতকাল বুধবার ( ২ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৩ টার দিকে বিলাপ করতে করতে কথা গুলো বলছিলেন নিহত ছাত্র রুবেল হোসেনের (২২) ছোট ভাই ফিরোজ হোসেন (২০)। এসময় তিনি বার শোকে মূর্ছা যাচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরেই ভাই ফোন করে খালি টাকা চাচ্ছিল। গত রোববার আমি ৮ হাজার দিছি, আরেক ভাই ৪ হাজার দিছে, হাসান কাকা ৮ হাজার দিছে। ওরা জিম্মি করে ভাইয়ের কাছে টাকা চাইতো। কয়দিনে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা দিছি। যহন আর টাকা পাইনি। তখন টাকা না পেয়ে মেরে দিছে ভাইডাক ‘। তাঁর ভাষ্য, ল্যাপটপ কেনার কথা বলে রুবেল স্বজনদের কাছে কয়েকদিন ধরেই মোবাইলে টাকা চেয়ে আসছিল। তিনি আরো বলেন, আমার ভাইকে হাত-পা- মুখ বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ছাদ থেকে ফেলে দিছে ওরা (অজ্ঞাত)। বুকে-পিঠে অনেক দাগ। আমি সুষ্ঠ বিচার চাই।
আসামিদের ফাঁসি চাই। এদিকে সন্তান হারানোর শোকে মাতম মা রিপা খাতুন। কিছুতেই থামছেনা তাঁর কাঁন্না। কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে বিলাপ বিলাপ করতে করতে তিনি বলছিলেন, ল্যাপটপ আমার বেটার জানরে। আমি সাড়ে ৬ হাজার টাকা দিছিরে। যেম্বা (যেভাবে) আমার বেটার জান বাড়ে নিছেরে। আমি সেম্বায়া জান চাইরে। আমি জানের জায়গা জান চাইরে। বেটা ইনজিনিয়ার হতি চাইছিল। নিহত রুবেল কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম ও গৃহিণী রিপা খাতুন দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে সেজো।
তাঁর বড় দুই বোন শারমিন (৩২) ও শাপলা (২৬)। তাঁদের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই ফিরোজ হোসেন সম্প্রতি পড়াশোনা বন্ধ করে চাষাবাদ শুরু করেছেন। তিনি কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাউয়ার ডিপার্টমেন্টের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র। গত মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে কুষ্টিয়া কোর্টপাড়ার এলাকার একটি চারতলা ভবনের ছাদ থেকে হাত – পা – মুখ বেঁধে তাকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। স্থানীয়রা উদ্ধার করে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে রাত সাড়ে ১২ টার দিকে রুবেলের মৃত্যু হয়।
তিনি ওই ভবনের তৃতীয় তলার ছাত্রাবাসে থাকতেন। বিকেলে সরেজমিন মির্জাপুর গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পিছনে সড়কের ধারে একটি ফাঁকা স্থানে রাখা রয়েছে পলিথিনে পেঁচানো রুবেলের নিথর দেহ। তাকে শেষ বারের মতো একনজর দেখতে স্বজন ও উৎসুক জনতা ভিড় করেছে। কাঁন্নার রোল চলছে। তাঁদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। পুরো গ্রাম যেন স্তব্ধ। তাঁরা ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। এসময় রুবেলের বাল্য বন্ধু ও চাচাতো ভাই রকি আহমেদ বলেন, রুবেল খুব ভাল ছেলে। এলাকায় কোনো বদনাম নেই। কোনো রাজনীতির সাথেও জড়িত নয় সে। গত শনিবার ও রোববার রুবেল তাঁর কাছেও ল্যাপটপের কথা বলে ফোনে পাঁচ হাজার টাকা ধার চেয়েছিল।
প্রতিবেশী মো. আলিমন হোসেন সিয়াম আক্ষেপ করে বলেন, ঘটনা যাই ঘটুক। তাই বলে কি এভাবে কাউকে মেরে ফেলতে হবে। এবিষয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক মিঠুন চক্রবর্তী বলেন, রাত ১১টার দিকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। আশংকাজনক অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয়েছিল।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ১০ নম্বর ওয়ার্ডের নার্সরা জানান, রুবেল নামের রোগীকে মুমূর্ষু অবস্থায় ভর্তি করা হয়েছিল। ভর্তি করার আধা ঘণ্টা পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র লুৎফর হোসাইন রুবেলকে হাত-পা-মুখ বেঁধে চারতলা ছাদ থেকে ফেলে হত্যার ঘটনায় জড়িত প্রকৃত খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা।
গতকাল বুধবার (০২ সেপ্টেম্বর) দুপুর ২টার দিকে কুষ্টিয়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে হাজারো শিক্ষার্থী একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ক্যাম্পাস থেকে শহরের কাটাইখানা মোড়, হাসপাতাল মোড়, থানার মোড়ে হয়ে কোর্টপাড়া এলাকার বনফুড বেকারির সামনে মানববন্ধন করে। তিনি জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান। কুষ্টিয়া মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপেন্দ্র নাথ সিংহ বলেন, নিহত কলেজ ছাত্রের বাবা বাদী হয়ে থানায় এজাহার জমা দিয়েছেন। ঘটনার অধিকতর তদন্ত চলছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ছয়জনকে থানায় নেওয়া হয়েছে।
