সাবেক এমপি জর্জ ও তার চাচার বিরুদ্ধে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

সাবেক এমপি জর্জ ও তার চাচার বিরুদ্ধে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতনের অভিযোগ

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অটো রিকশাচালক মো. রনি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক আলতাফ হোসেন আসামির ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন।

শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের আদালতে তার ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে গত মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাতে রাজধানীর লালমাটিয়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। মামলা সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালীন গত ১৯ জুলাই দুপুর একটার দিকে মোহাম্মদপুর থানাধীন নূরজাহান রোডে প্রাইমারি স্কুলের সামনে গুলিবিদ্ধ হন রনি। তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় তার মা মোহাম্মদপুর থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

এদিকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগেও সেলিম আলতাফ জর্জকে নিয়ে বিতর্কের কোন শেষ ছিলো না। কুষ্টিয়া-৪ আসনে সাবেক সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি হয়ে কপাল খুলে যায় জর্জের। গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে সম্পদে ফুলেফেঁপে উঠেন জর্জ ও তার স্ত্রী।

প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে লাখপতি থেকে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। শুধু তাই-ই নয়, সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর খোকসা-কুমারখালী উপজেলার আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান জর্জ। গড়ে তুলেছেন এমপি লীগ। তার লোকজন দিয়ে নানান অনিয়ম দুর্নীতি শুরু করে। কুমারখালী-খোকসা উপজেলায় পরিচিতি পেয়েছেন মামলাবাজ এমপি হিসেবে। নিজের কথার বাইরে গেলে অনুগতদের দিয়ে ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে মামলা করান। এসব মামলার বিবাদী অধিকাংশই আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

সেলিম আলতাফ নিজেকে সর্বত্র ব্যারিস্টার হিসেবে পরিচয় দিলেও আদতে তিনি তা নন। ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টার রেকর্ডে সেলিম আলতাফ নামে কোনো ব্যরিস্টারের রেকর্ড নেই। যার ফলে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ দ্বিতীয় বারের মতো আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান। দলীয় কোনো পদ-পদবি না থাকলেও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পান এবং এমপি নির্বাচিত হন। পরে তাকে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়।

কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী-খোকসা) আসনে বিজয়ী হয়েছেন ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রউফ। তিনি পেয়েছেন ৯৮ হাজার ৪১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বর্তমান এমপি সেলিম আলতাফ জর্জ নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ৮০ হাজার ১১১ ভোট। এমপি হওয়ার আগে তার সম্পদের পরিমাণ ২৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। পাশাপাশি বেড়েছে স্ত্রীর সম্পদও। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জর্জের নির্বাচনী হলফনামার সম্পদ বিবরণী থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জমা দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাঁচ বছর আগে জর্জের আয় ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ৮৩৬ টাকায়।

আয় বাড়ার পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে কয়েকগুণ। ৫ বছর আগে তার স্থাবর ১০ লাখ ও অস্থাবর ২৬ লাখ ৫০ টাকার সম্পদ ছিল। বর্তমানে তার স্থাবর সম্পদ আছে ১০ লাখ টাকার ও অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১ কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ সময় তার স্ত্রীর সম্পদ ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ টাকায়। এক কোটি ৮৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা সম্পদের মালিক এ দম্পতি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় সেলিম আলতাফ জর্জের স্থাবর-অস্থাবর ৩৬ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের মধ্যে নগদ ১০ লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ছিল ১৫ লাখ টাকা, আসবাবপত্র এক লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২ দশমিক ৪৫ একর কৃষি জমি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যৌথ মালিকানার ৪ কক্ষ বাড়ির ২ কক্ষ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দেখানো হয়েছে। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় এক কোটি ৫২ লাখ ৫০ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ ১২ লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ৩৭ লাখ টাকা, ৮০ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের একটি প্যারাডো ভিএক্সআর-১ গাড়ি, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১০০ ভরি স্বর্ণালংকার, এক লাখ ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রনিকস সামগ্রী (এসি, ল্যাপটপ ইত্যাদি) ও এক লাখ ৫০ হাজার টাকার আসবাবপত্র দেখিয়েছেন  জর্জ এমপি।

স্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে ২ দশমিক ৪৫ একর কৃষি জমি ৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যৌথ মালিকানার ৪ কক্ষ বাড়ির ২ কক্ষ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও দশমিক ৪৩ একর কৃষি জমি দেখানো হয়েছে। ৫ বছর আগে স্বর্ণালংকার ও গাড়ি না থাকলেও বর্তমানে জর্জের এক কোটি টাকা মূল্যের স্বর্ণালংকার ও গাড়ি রয়েছে। ৫ বছর আগে জর্জের বার্ষিক আয় ছিল সাড়ে তিন লাখ টাকা। তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ৮৬ হাজার ৮৩৬ টাকায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় তার স্ত্রীর ২১ লাখ ৫০ হাজার টাকার সম্পদের মধ্যে ছিল বিয়ের সময় উপহার হিসেবে পাওয়া ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১০০ ভরি স্বর্ণালংকার এবং এক লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিকস পণ্য।

অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামায় জর্জের স্ত্রীর ২৭ লাখ টাকার সম্পদের মধ্যে রয়েছে নগদ এক লাখ টাকা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা ২০ লাখ টাকা, ছয় লাখ টাকা মূল্যের ইলেকট্রনিকস সামগ্রী (ফ্রিজ, টিভি অন্যান্য) এবং একটি টয়োটা হ্যারিয়ার গাড়ি দেখানো হয়েছে। গাড়িটির মূল্য উল্লেখ করা হয়নি। গাড়িটি তার শ্বশুর উপহার হিসেবে দিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ৫ বছর আগে তার ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১০০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিল, এবার তার কোনো স্বর্ণালংকার নেই। কুমারখালী-খোকসা এলাকার আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ দুই উপজেলার ওয়ার্ড পর্যায় থেকে শুরু করে উপজেলার শীর্ষ পদ পর্যন্ত সরকারি দলের নেতাকর্মীরা প্রায় সবাই মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত।

কারও বিরুদ্ধে একটি থেকে শুরু করে দশটিরও অধিক মামলা হয়। বিরোধী দলের আমলে বাড়িতে থেকে রাজনীতি করতে পারলেও সরকারি দলের অনেকেই নিজ বাড়িতে থাকতে পারতেন না। হারিয়েছেন সম্পদ। কেউ কেউ মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে দুনিয়ার মায়াও ত্যাগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এসব মামলা এবং নির্যাতনের পেছনে রয়েছে সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ। এ দুই উপজেলায় ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ শব্দটি করলেও মামলার ঘানি টানতে হয়। প্রতিবাদ করা যায় না নির্যাতন-দখলের বিরুদ্ধেও। সেলিম আলতাফের বাড়ি কুমারখালী উপজেলায়। নির্বাচনে জয়লাভ করার পর থেকে কুমারখালী পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান অরুণকে নিয়ে আলাদা বলয় গড়ে তোলেন। অরুণ সম্পর্কে সেলিম জর্জের চাচা।

আধিপত্য তৈরি করতে বেছে নেন দলীয় নেতাকর্মী নির্যাতনের পথ। এসব বিষয়ে সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যারা এ ধরনের মামলার অভিযোগ আনছে, তারা দলের ভালো চায় না বলেই এসব রটাচ্ছে। অভিযোগের পক্ষে অবশ্যই প্রমাণ থাকে, শুধু মুখ দিয়ে বললে হবে না। এটি কেবল ব্যক্তি আক্রোশ নয়, দেশ ও দলের বিষয়ও আছে। সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা মাত্র। সামগ্রিকভাবে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চলছে। ব্যারিস্টারি ডিগ্রির বিষয়ে সেলিম আলতাফ বলেছিলেন, এটা ভিত্তিহীন অভিযোগ। এ ধরনের অভিযোগ দেওয়ার আগে এর সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে। নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে এ ধরনের ব্যক্তি আক্রমণ করা, প্রচারণা বন্ধ করা উচিত।