কুষ্টিয়ায় শেষ হলো তিনদিন ব্যাপী লালন স্মরণোৎসব
খুলনা বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ আব্দুর রশিদ বলেছেন, আধ্যাত্মিক সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে সত্য ও জাতহীন সমাজ গড়তে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। লালন সাঁই এক বিশ্ব মানব। কারো কারো মতে নিরক্ষর বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের সৃষ্টি গানে গভীর জ্ঞান আমাকে সত্যিকার অর্থে বিমোহীত করেছে। তিনি আজকের যুগেও মানুষের হৃদয়ের মাঝখানটা দখল করে আছেন। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ভাষায় গবেষনা হচ্ছে। হচ্ছে তাঁর গানের ভাষান্তর। যুগে যুগে মানুষের কল্যাণে জ্ঞানী-গুনি ও পথ প্রদর্শকদের জন্ম।

কুষ্টিয়ায় শেষ হলো তিনদিন ব্যাপী লালন স্মরণোৎসব
সোমবার রাতে ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ৩দিনব্যাপী স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁই জ্ঞানভান্ডারে এক অনাবিস্কার পৃথিবী। লালন সাঁই ছিলেন বাঙালি জাতিসত্বা বোধের প্রবাদ পুরুষ। তাঁকে চিনতে অনেক দেশ বহুভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমি নিজেও তাঁর একজন ভক্ত হয়ে উঠেছি। তেমনি কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ার পবিত্র মাটিতে লালন সাঁইয়ের মত মহাত্মা মহাজ্ঞানীর জন্ম হয়েছে। মানবজনমের পূর্নজন্মে লালন কোন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন না। লালন সাঁই সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানতাবাদীর পথে ডাক দিয়ে ছিলেন।
বক্তব্যের মাঝে তিনি দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে লালন সাঁইয়ের বিখ্যাত গান “মিলন হবে কত দিনে,আমার মনের মানুষের সনে” গেঁয়ে শোনান।
তিনি বলেন, তাই আমি নিজে লালনের গানের ভক্ত। লালন সাঁই মানবতার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই অসংখ্য গান লিখে গেছেন। মানুষেরা ভজলে যে প্রকৃত সরল ও খাটি মানুষ হওয়া যায় লালন মানুষকে শিখিয়েছিলেন। ধর্মের বেড়ালে মানুষকে আটকিয়ে রাখা যাবে না। কোন ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় না। সকল ধর্মের উপর মানব ধর্ম। এই মরমী সাধকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন আধুনিক সমাজ বিন্যাসে স্ব-শিক্ষিত। ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে কি অসীম কথা বলেছেন তিনি। তিনি বলেন দেহ এবং আত্মার মাঝে বসবাসকারীকে আমরা সহসায় না চিনতে পারলেও লালন সাঁই গানের মধ্যে চিনিয়েছেন সে কোনজনা।
আলোচনার শুরুতে এবং শেষে অতিথিদের কুষ্টিয়া লালন একাডেমীর পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া, আত্মসুদ্ধির প্রতীক একতারা ও নবনির্মিত একতারার ক্রেষ্ট ও উত্তরিয় উপহার দিয়ে বরণ করে নেন।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন খুলনা রেঞ্জ অতিরিক্ত ডিআইজি নওরোজ হাসান তালুকদার ,কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, কুষ্টিয়া জজ আদালতের জিপি এ্যাড.আখতারুজ্জামান মাসুম, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার প্রফেসর ড.সেলিম তোহা, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব রফিকুল আলম টুকু,কুষ্টিয়া জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক বিশিষ্ট নাট্যব্যাক্তিত্ব আমিরুল ইসলাম,গাজী মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ।
ফকির লালন সাঁইয়ের আধ্যাত্মিকতা তুলে ধরে প্রধান আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসার ড.সরোয়ার মুর্শেদ রতন। আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট লালন গবেষক ও লেখক এ্যাড.লালিম হক। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) নাসরিন বানু। স্বাগত বক্তব্য রাখেন লালন একাডেমির এ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের এনডিসি শাহেদ আরমান।
এবারের বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ৩দিনব্যাপী স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে আসা দেশ-বিদেশের লাখ ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরুদের চরণ ধূলায় সিক্ত বাউল সম্রাটের ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ী। সাঁইজির মতাদর্শের ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে মানুষ নিবেদিত থাক চিরকাল এবং মানবতার নিগুড় প্রেমের ভাবধারা বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে ভক্তকুলের অঙ্গীকার। সভ্যতার এই যুগে মানুষ মানুষে হিংসা বিদ্বেশ ভূলে সাঁইজির জাতহীন মানব দর্শনের “মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” এই শ্লোগানকে বাস্তবায়নে সদা সত্য ও সঠিক পথে চলে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখতে হবে। মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের অহিংস মানবতা ও ফকিরী মতবাদের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বাঙ্গনে নিজের মহিমায় জায়গা করে নিলেও বাংলা ভাষা ব্যতিত অন্য কোন ভাষায় প্রকাশ, প্রচার ও প্রসার ঘটেনি তেমন একটা। এব্যাপারে আরো উদ্দ্যেগী হতে হবে।
লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ৩দিনব্যাপী স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠান সফল স্বার্থক ও সুন্দর ভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আইনশৃংখলায় নিয়োজিত পুলিশ, র্যাব, স্থানীয় সেচ্ছাসেবকবৃন্দ, দেশ-বিদেশ থেকে আসা লালন সাঁইয়ের অগনিত ভক্ত অনুরাগী ও সাধু-গুরু, সাংবাদিক সহ এলাকার সুধীজনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন ও ধন্যবাদ জানান।
আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালন সংগীতি পরিবেশিত হয়। এতে সংগীত পরিবেশন করেন উপহমাদেশের প্রখ্যাত লালন সঙ্গীত শিল্পী চন্দনা মজুমদার, শাহানাজ বেলি, বাউল শিল্পী সমীর বাউল সহ দেশের খ্যাতিনামা শিল্পীবৃন্দসহ লালন একাডেমীর স্থানীয় শিল্পিরা। ৩দিনব্যাপী স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানমালার সার্বিক পরিচালনা ও উপস্থাপনা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রে সিফাতুন নাহার, কাজী শারমিন নেওয়াজ, ফারহানা ইয়াসমিন ও কনক চৌধুরী।
