বিশেষ প্রতিনিধি ॥ এক যুগ আগেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের দৃশ্যমান তেমন কোন ব্যবসা ও সম্পদ ছিল না। তবে আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতা থাকার সুযোগে মাহবুবউল আলম হানিফ হয়ে ওঠেন ক্ষমতাধর নেতাদের একজন পাশাপাশি গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছাড়াও রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত ৪টি জেলায় তার সম্পদ ও ব্যবসা-বানিজ্যে আছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। সামান্য উপজেলার নেতা থেকে হানিফ গত দেড় যুগে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারন সম্পাদকের পদ পেয়ে আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়ে যান।
এ পদকে পুঁজি করেই সারাদেশে তার জাল ফেলে তৈরি করেন বড় নেটওয়ার্ক। বাগিয়ে নিয়েছেন নানা ব্যবসা-বানিজ্যে। গড়ে তোলেন বিশাল সম্রাজ্য। রাজকীয় ভাবে চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন হানিফ। দেশে নানা সম্পদ গড়ার পাশাপাশি কানাডাসহ কয়েকটি দেশে হানিফের সম্পদ ও ব্যবসা আছে বলেও জানাগেছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গা ঢাকা দিয়ে আছেন হানিফ। তার সম্রাজ্যে ভেঙ্গে পড়েছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর গা ঢাকা দিয়ে আছেন হানিফ। তার দোসররাও পালিয়ে গেছে। হানিফের উত্থান যেভাবে: মাহবুবউল হানিফের বড় ভাই সাবেক সচিব রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাই।
সেই সুত্র ধরেই হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান হানিফ। তবে পরাজিত হন। এরপর আরো কয়েকবার দলীয় মনোনয়ন পেলেও বিজয়ী হতে পারেননি। এরপর ২০০৮ সালে মহাজোট গঠনের পর হানিফে মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এরপর দল ক্ষমতায় এলে তাকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হয়।
২০১৩ সালের নির্বাচনে সদর আসন থেকে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন হানিফ। কাউন্সিলে পেয়ে যান যুগ্ম সাধারন সম্পাদকের মত শীর্ষ পদ। এরপর হানিফকে আর পিছে তাকাতে হয়নি। দলের পদ ভাঙ্গিয়ে গড়ে তোলেন বিশাল সম্রাজ্য। বাড়তে থাকে তার প্রভাব-প্রতিপত্তি। দলে তার অবস্থান আরো পাকা পোক্ত হয় একাধিকবার একই পদ পেয়ে যাওয়ার কারনে। মন্ত্রী হওয়ার খায়েস থাকলেও সে আশাপূরণ হয়নি নানা অপকর্মের কারনে।
তবে রাজনীতির আড়ালে অর্থ আয় করা ছিল তার নেশা। তিনি দলের নেতা-কর্মিদের পাত্তা না দিলেও বড় বড় ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত করে চলতেন। কুষ্টিয়াতেও চলতেন টাকা ওয়ালাদের সাথে। এভাবে গত ১৫ বছরে অঘাধ সম্পদের মালিক বনে গেছেন হানিফ। হানিফের পুরো পরিবার থাকে কানাডায়। সেখানে তার কয়েকজন ভাই ও বোনেরাও বসবসা করে। হানিফের সেখানে গাড়ি-বাড়িসহ সম্পদ আছে বলে জানা গেছে। নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়: হানিফের কপাল খুলে যায় শেখ পরিবারের আত্মীয় হওয়ার সুবাধে। দলের শীর্ষ পদ পাওয়ার পরই তার কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে।
দলের পদ-পদবি পাওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে আসতেন তার কাছে। এছাড়া ঢাকা কেন্দ্রিক নানা কাজের তদবিরও করতেন হানিফ। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থ বানিজ্যে করেছেন তেমনি নানা তদবির, টেন্ডার বানিজ্যে, বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত কোটি টাকা। হানিফের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েষ্ট ইন্টারন্যাশনাল। কাওরান বাজারে বিএমটিসি ভবনে তার ব্যবসায়ীক ও রাজনৈতিক অফিস। সেই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সব কিছু একহাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন হানিফ। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে হানিফ তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন।
সর্বশেষ স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইসেন্স নেন। লালন কলা বিশ্ববিদ্যালয় নামে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন জেলা পরিষদের নতুন ভবনে। জেলা পরিষদ সুত্র জানায়, ৭ম ও ৮ম তলা ভাড়া করেছিলেন। মাসিক ৩ লাখ টাকা ভাড়ায় নেন হানিফ। আর এককালিন দিয়েছিলেন প্রায় অর্ধকোটি টাকা। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা শেষ হলেও পট পরিবর্তনের কারনে কার্যক্রম আপাতত বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠান সাজাতে বিনিয়োগ করেছিলেণ কয়েক কোটি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে হানিফের পার্টনার ছিল হেলথকেয়ার ফার্মার সিইও হালিমুজ্জামান, ব্যবসায়ী ও জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ অজয় কুমার সুরেকাসহ আরও কয়েকজন শীর্ষ ব্যবসায়ী। হানিফের স্ত্রী ফৌজিয়া আলম ছিলেন ট্রাষ্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাষ্টি বোর্ডের সহ-সভাপতি ছিলেন হানিফর আস্থাভাজন হালিমুজ্জামান। দলের একাধিক সুত্র জানিয়েছে, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে শতশত কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন হানিফ। এসব টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে।
আর দেশে কয়েকটি বড় বড় কোম্পানীর সাথে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এর মধ্যে স্প্রেক্টা লিমিটেড, ওয়েষ্ট্রার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং অন্যতম। কাগজে-কলমে না থাকলেও এ দুটি কোম্পানীর সাথে হানিফের পার্টনারশীপ আছে। এছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়া হানিফের ভাই আতার যে মার্কেট, দোকান ও শপিংমলে দোকান আছে সেগুলো দুইজনের অর্থে ক্রয় করা বলে জানা গেছে। এর মধ্যে জেলা পরিষদ অফিস সুত্র জানিয়েছে, তাদের নতুন দুটি দোকান নেওয়া আছে কোটি টাকায়। এছাড়া তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারন সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক জানান, খেলার মাঠের পশ্চিম পাশে নতুন যে মার্কেট হয়েছে সেখানে ৮টি দোকান আছে তাদের নামে। দোকানের ভাড়াটিয়ারা জানান, প্রতিমাসে হানিফের ভাই আতা টাকা তুলতেন।’
জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় যে দোকান আছে সেখানে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। প্রতিটি দোকান ভাড়া দেওয়া আছে। স্থাণীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে। শহরের বহুতল বিপনী বিতান পরিমন টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে হানিফ ও আতার নামে। মার্কেট কমিটি জানায়, দুটি দোকানের দাম কোটি টাকার ওপরে। ভাড়া দেওয়া আছে কোদান দুটি। ভাড়া ওঠে প্রতি মাসে অর্ধলাখ টাকা। এছাড়া সমবায় মার্কেটের নিচ ও দোতলায় একাধিক দোকান আছে। সেখানে ব্যবসা আছে হানিফ ও আতার। যৌথভাবে এসব ব্যবসা করতেন দুই ভাই। শহরের হাউজিংয়ে ৫ কাঠার প্লটের ওপর ১০তলা বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে। প্রতি তলায় ৪টি করে ফ্লাট আছে। হাউজিং এলাকার বাসিন্দা আনিসুর রহমান বলেন, হাউজিং এর জমির সাথে স্থাণীয় একজনের জমি দখল করে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয় কয়েক বছর আগে।
আতার নামে হলেও পেছণে ছিলেন হানিফ। লোকজনের চোখ এড়াতেই হানিফ এ বাড়ি আতার নামে করেছেন বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এসব ফ্লাট সজ্জিত করতে দেশের বাইরে থেকে টাইলসসহ ফিটিংসের মালামাল আনা হয়। পিটিআই রোডে ৪ কাঠা জমির ওপর তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেন হানিফ। কাগজে কলমে আতা ও তার স্ত্রীর নামে হলেও হানিফের অর্থে এ বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে বলে স্থাণীয়রা জানান। প্রথম দিকে লালন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড এ বাড়িতে লাগানো হয়। আতার সম্পদ নিয়ে দুদক অনুসন্ধান করার পর সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়। এছাড়া ঢাকা ও কুষ্টিয়ায় তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, শেয়ার, ব্যাংকে ডিপোজিট আছে। দল ও অন্য কয়েকটি সুত্র জানায়, হেলথ কেয়ারের সিইও হালিমুজ্জামানের সাথে হানিফের ব্যবসায়ীক পার্টনার আছে। দেশের বাইরে একটি বড় রাষ্ট্রে হেলথ কেয়ারের বিনিয়োগ আছে। সেখানে হানিফের অর্থ লগ্নি করা আছে। একই সাথে কুষ্টিয়ার শীর্ষ ব্যবসায়ী অজয় সুরেকার সাথে বিভিন্ন ব্যবসায়ী কোটি কোটি লগ্নি করা আছে হানিফের।
এসব কারনে অজয় সুরেকাকে জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ করেন হানিফ। এসব বিষয়ে কথা বলতে হালিমুজ্জামানের মোবাইলে রিং দিলেও তা বন্ধ পাওয়া গেছে। আর অজয় সুরেকা হানিফের সাথে সম্পর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগে জোর করে পদ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন। এর বাইরে হানিফের সাথে অন্য কোন সম্পর্ক নেই বলে জানান তিনি। হানিফের পরিবারের সদস্যরা কানাডায় থাকেন। সেখানে হানিফের মেজ ভাই , এক বোন ও বোনর স্বামী থাকেন। সুত্র জানিয়েছে, হানিফ স্ত্রী ফৌজিয়া আলমের নামে কোন কিছু খরিদ না করলেও ভাই ও বোনের নামে সম্পদ করেছেন। এর মধ্যে হানিফের টাকায় সেদেশে একটি গ্যাস ষ্টেশন করেছেন তার ভাই। এছাড়া বাড়ি আছে বোন ও ভাইয়ের নামে। বোনের স্বামীও হানিফের টাকায় নানা ব্যবসা-বানিজ্য করেন বলে জানাগেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হানিফে দলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে নদী খননের বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন সারা দেশে। তার নিজের একাধিক ড্রেজার আছে খননের জন্য।
সর্বশেষ গড়াই খননের একটি কাজ বাগিয়ে নেন তিনি। সরকারি খরচের তুলনায় কয়েকগুন বেশি খরচে তিনি কাজ করেন। এতে তার নিজের ৩টি ড্রেজার কাজে লাগান। প্রতি ডেজ্রারের ৩০ কোটি টাকার বেশি বলে সুত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা আছে হানিফের। সর্বশেস সংসদ নির্বাচনেও হানিফের নগদ টাকার পরিমান বহু গুন বেড়েছে বলে দেখাগেছে। ২০১৩ সালের নির্বাচেন আগে একটি সাধারন মানের গাড়ী চড়লেও পরবর্তিতে তিনি একাধিক দামী গাড়ী ক্রয় করেন। যার প্রতিটির দাম কোটি টাকার ওপরে। ঢাকায় গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্লাট আছে, আছে বনানীতে। এছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সাথে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী, কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিপোর্ট। দুবাই, কানাডা, আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে তার ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে বলেও একটি সুত্র নিশ্চিত করেছে। কুষ্টিয়ার একজন ব্যবসায়ী ও এক ব্যারিস্টার তার টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছে বলে কানাঘুষা আছে।
কক্সবাজারের টেকনাফের আলোচিত সাবেক সাংসদ বদির সাথে হানিফের ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে। সেখানে সম্পদ গড়েছেন হানিফ। আলোচিত মাদক কারবারি বদির মাধ্যমে এ অঞ্চলে মাদকের চালান আসত বলেও একাধিক সুত্র জানিয়েছে। সে মাদকের কারবার নিয়ন্ত্রন করত হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতা। এসব কারনে কুষ্টিয়ায় মাদক কারবারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারনেনি তৎকালিন পুলিশ কর্মকর্তারা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুত্র জানিয়েছে, দেশের বিতর্কিত ঠিকাদার ওয়েস্ট্রার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং এর মালিক বসির উদ্দিনের সাথে বেনামে যৌথ ব্যবসা আছে হানিফের। নদী খনন ও শাসনের কাজ করেন বসির ও হানিফ। বসিরের বিরুদ্ধে কাজের নামে কোটি কোটি টাকা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগও আছে। তবে হানিফের কারনে পার পেয়ে গেছেন বসির।
সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্ম নদী শাসনের জন্য ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাশ হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকার অফিসে বসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কজ্বায় নিয়ে নেন। এসব কাজ পরবর্তিতে বসিরের কাছে কমিশনে বিক্রি করে দেন। এ কাজ থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। হানিফের সময় কুষ্টিয়ায় বেশ কয়েখটি বড় প্রকল্পের কাজ হয়েছে। এর মধ্যে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, কুষ্টিয়া শহর ফোর লেন সড়ক প্রসস্তকরণ, কুষ্টিয়া বাইপাস সড়ক নির্মাণ, শেখ রাসেল কুষ্টিয়া-হরিপুর সেতু নির্মাণ, মুজিবনগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্প। এছাড়া সম্প্রতি পদ্মা নদী শাসনে বড় একটি প্রকল্পের টেন্ডার হয়েছে। এসব প্রকল্পের প্রতিটি থেকেই হানিফ আগাম বাগিয়ে নেন কোটি কোটি টাকার কমিশন। প্রতিটি প্রকল্প থেকে শতকরা ১০ থেকে ১৫ভাগ কমিশন আদায় করতেন হানিফ। তার বাসায় বসে এসব ভাগাভাগি হতো। সেখানে সরকারি কর্মকর্তারা রাতে গিয়ে অর্থ দিয়ে আসতেন।
এছাড়া নিয়োগ বানিজ্যে, বালু ঘাটের কমিশনসহ অন্যান্য কাজ থেকে যে আয় হতো তা হানিফ চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতার মাধ্যমে সংগ্রহ করতেন। সেই টাকা আতা নিজে হানিফের কাছে পৌঁছে দিত বলে জানান দলের নেতারা। এছাড়া হানিফের এপিএস জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আমজাদ হোসেন রাজুর ঢাকায় ও কুষ্টিয়া ব্যবসা ও ফ্লাট আছে। তার সাথেও হানিফের ব্যবসা আছে দলীয় সুত্র জানিয়েছে। সর্বশেষ কুষ্টিয়া মেডিকেলে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে হানিফের পছন্দের প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হানিফ। কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারী কাজ, হাট ঘাটের ইজারা, সরকারী বেসরকারী অফিস আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালু মহাল থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমন কি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগি সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে। হানিফ কুষ্টিয়ার রাজনীতি ছাড়াও সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি স্কুল কমিটির সভাপতি কে হবে সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন হানিফ।
তিনি এমপি হলেও মন্ত্রীর থেকে বেশি প্রটোকল পেতেন। কুষ্টিয়ায় আসলে সামনে ও পেছনে থাকতো পুলিশের ভ্যান। এছাড়াও স্পেশাল সিকিউরিটি পেতেন তিনি। হানিফ কুষ্টিয়ায় আসলে ঘিরে থাকতেন ব্যবসায়ীদের একটি দল। তাদের কারনে দলীয় নেতা-কর্মিরা কথা বলার মত সুযোগও পেতেন না। দলের নেতাদের বাদ দিয়ে তিনি বিএনপি-জামায়াতপন্থি ব্যবসায়ী ও নেতাদের সাথে আঁতাত করে তাদের কাছে ভেড়ান। তাদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে সব প্রতিষ্ঠান থেকে লুটে নেন কোটি টাকা। বিশেষ করে খাজানগর এলাকার তিনজন চালকল মালিকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এর মধ্যে ফ্রেস এগ্রো ফুড, দেশ এগ্রোফুড, মেসার্স সুবর্না অটো মিলের মালিকের সাথে তার দহরম ছিল বেশি। একই সাথে কুষ্টিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে বিগত ১৬ বছরে। এ টাকার বড় একটি অংশ দিয়ে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস নির্মাণ করেন হানিফ। এছাড়া কুষ্টিয়া শহরের ফোর লেন সড়ক নির্মাণ কাজের একটি প্যাকেজ হানিফের পার্টনার স্প্রেকটা লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এ লাইসেন্সে হানিফ নিজেই কাজ করেন। এছাড়া মুজিব নগর সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পে গত ৪ বছরে শত শত কোটি কোটি টাকার ভাগ বাটোয়ারা হয়েছে। সব কাজ ভাভাভাগি করেছেন হানিফ ও তার ভাই আতাসহ আওয়ামী লীগের নেতারা। মুজিব নগর সমন্বিত প্রকল্পের প্রকৌশলীরা জানান, টেন্ডারে বেশির ভাগ কাজ নিতেন আতা।
হানিফের নির্দেশে তাকে বড় বড় কাজ দিতে হয়েছে। হানিফের অত্যাচার নির্যাতন থেকে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন বাদ যায়নি তেমনি বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মিদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়ে তার বাহিনী দিয়ে। জেলা যুবদল নেতা আল আমিন কানাই বলেন, গত নির্বাচনের আগে কাউন্সিলর কৌশিক আহম্মেদ বিচ্চু আমার বাসায় গিয়ে জানাই হানিফের ভাই আতাউর রহমান আতা সাহেব চা ভাবে। আমি বলি এত বড় নেতার সাথে চা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এরপর থেকে তারা আমার বাড়ির ওপর মাস্তান পাঠিয়ে হেনস্থা করে, আমার নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করেছে। এখন আমি ব্রেইন স্ট্রোক করে রোগী। মানসিক ও শারিরীক ভাবে তারা আমাকেসহ দলের বহু নেতাকে তারা গত ১৬ বছরে শেষ করে দিয়েছে। এদিকে ছাত্রলীগের কুষ্টিয়ায় বাড়ী প্রবাসী নেতা খন্দকার মাহতাবুল হক জয় তার নিজের ফেসবুকে লিখেছেন ‘সুইপার থেকে সুপারস্টার সবকিছুর টাকা তার পেটে, আমরা ত্যাগী ও প্রবীণ, সকল দলের সাথে আমাদের সৌহার্দ্যতা।
আওয়ামী লীগ করি আওয়ামী লীগ করব কিন্তু হানিফ ও আতা কুষ্টিয়া শহর সদরের রাজনীতিতে যদি কোনদিন ফিরে তাহলে ঐদিন আদর্শকে কোরবানি দিব’। হানিফের নামে নিউজ করে মামলা ও হামলার স্বীকার হয়েছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। এর মধ্যে কুষ্টিয়া ছাড়া হয়েছে একাধিক সংবাদ কর্মি। মামলা দিয়ে জেলে পাঠান যুগান্তর প্রতিনিধি এএম জুবায়েদ রিপন, বাংলাভিশনের রিপোর্টার হাসান আলী, বর্তমানে সময় টিভি রাজশাহীতে কাজ করেন মওদুদু রানাকে। (যমুনা টিভিতে কর্মরত ছিলেন)। এর বাইরে জুয়েল আহম্মেদ শাহিন ও অঞ্জন শুভ নামের দুই সাংবাদিক হানিফের রোসানলে পড়ে মিথ্যা মামলায় কারাগারে যান।
এদিকে হানিফ ও আতাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে। গা ঢাকা দিয়েছে সব নেতা। এর মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে কথা হয় বর্তমান পরিস্থিতি ও হানিফ এবং আতার বিষয়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন,‘ হানিফ রাজনীতি করার জন্য কুষ্টিয়ায় আসেনি। এ এসেছিল বানিজ্যে করার জন্য। তার সময় দল যেমন ধ্বংস হয়েছে তেমনি বিএনপি ও অন্য দলের গুটিকয়েক নেতা ও ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। এদের মাধ্যমে হানিফ সিন্ডিকেট করে সব কাজ থেকে টাকা নিয়ে গেছেন। তিনি দেশের বাইরে টাকা পাচার করেছেন, গাড়ি ও বাড়ি করেছেন সেখানে। নেতা-কর্মিরাও তার হাত থেকে রেহায় পাইনি।
