রঞ্জুউর রহমান ॥ এ বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে সাবেক প্রধান মন্ত্রী দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়। সেই সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়। প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনায় দেখা যায় রদবদল। তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের অনেক আওয়ামী লীগ নেতা দেশ ছেড়ে আশ্রয় নেয় বিদেশে। আর বাকী আওয়ামী লীগ নেতারা চলে যায় আত্নগোপনে। এদিকে দেশের ক্ষমতার পালাবদলের সাথে সাথে সারা দেশের মত কুষ্টিয়ার মিরপুর থানা পুলিশের কর্যক্রমও অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। যার কারণে মিরপুর উপজেলা ব্যাাপী প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরির ঘটনা। মিরপুর উপজেলা ব্যাপি ডাকাতি, ছিনতাই, চুরির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। অথচ ভুক্তভোগীরা থানায় অভিযোগ দিলেও পাচ্ছে না প্রতিকার। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছে থানা পুলিশ। এছাড়াও ৫ আগস্টের পর থেকে পুরো উপজেলা ব্যাপি মাদকের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে।
মাঝে মাঝে পুলিশের অভিযানে মাদক উদ্ধার হলেও মাদক ব্যবসায়ীরা থেকে যাচ্ছে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। পুলিশের এমন স্থবিরতা নিয়ে মিরপুর উপজেলার জনমনে চলছে নানা প্রশ্ন। কোন পথে হাটছে পুলিশ ? কেন চলছে তাদের এমন নিরবতা? জনগনের জানমাল নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হচ্ছে পুলিশ। পুলিশকে বেগবান হতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়ার মিরপুরে গত ২৩ ডিসেম্বর শুক্রবার রাতে ৫টি গরু চুরি ও বিকেলে ১টি ছিনতাইয়ের ঘটনার পাশাপাশি একই দিনে আরো ৪টি মোটরসাইকেল চুরির তথ্য পাওয়া গেছে। একই দিনে জুম্ময়ার নামাজের সময় এসব মোটরসাইকেল চুরির ঘটনা ঘটে বলেও জানা গেছে। জানা যায়, উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের পুরাতন আজমপুর বাজার মসজিদের ইমাম আহসান হাবীব লিংকন জুমার নামাজ শেষ করে বের হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে রাখা তার ডিসকভার গাড়িটি খুঁজে পাননি। তার মোটরসাইকেলটি চুরি হয়ে গেছে বলে তিনি জানান।
একই সময়ে কাকিলাদহ গ্রামের শফিকুল ইসলামের ডিসকভার মোটরসাইকেল, পুরাতন আজমপুর গ্রামের জহরুল ইসলামের স্পেলেন্ডার মোটরসাইকেল ও মাজিহাট জুম্মার নামাজের সময় একজনের গাড়িসহ মোট চারটা মোটরসাইকেল একইদিনে চুরির ঘটনা ঘটে। গত ২৪ ডিসেম্বর মিরপুর পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের মোশারফপুর মাঠ থেকে রাতের অন্ধকারে তিনটি সেচ পাম্প চুরি হয় বলে জানা গেছে। এছাড়াও কয়েক দিন আগে মিরপুর বাসস্ট্যান্ড মসজিদে এ আসরের নামাজের সময় ও ছাতিয়ান কালিতলা মাঠ থেকে একটি করে মোটরসাইকেল হারিয়ে গেছে বলে জানা যায়। ছাতিয়ান কালিতলা মসজিদ থেকেও তিনটা বাইসাইকেল চুরি হয়েছে। নিখোঁজের চার দিন পর ৯ আগস্ট দুপুর ১২টার দিকে কুষ্টিয়ার সদর উপজেলার পাটিকাবাড়ী গ্রামের একটি পুকুর থেকে আসাদুল (৫০) নামের এক ব্যবসায়ীর অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত আসাদুল মিরপুর উপজেলার আমবাড়ীয়া ইউনিয়নের মহাম্মদপুর গ্রামের মৃত আফসার আলীর ছেলে।
তিনি ছিট কাপড়ের ব্যবসা করতেন। পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় পূর্ব শত্রুতার জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে। গত ২৭ অক্টোবর (শনিবার) কুষ্টিয়ার মিরপুরে জাহাঙ্গীর আলম নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। গভীর রাতে উপজেলার আমবাড়ীয়া ইউনিয়নের নতুন সুতাইল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত জাহাঙ্গীর আলম চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা থানার কেদারনগর গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে। এছাড়াও উপজেলার কোন কোন এলাকায় প্রতিদিন মারামারি, চুরি এবং ছিনতাই নিত্যনৈমিত্ত্ব ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই মাদকের প্রভাব উপজেলা ব্যাপি যেভাবে বিস্তার লাভ করছে তাতে করে প্রতিটি অভিভাবকই তাদের উঠতি বয়সী সস্তানদের নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন যাপন করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুর উপজেলার নওদা খাদিমপুরের এক মাদকসেবী বলেন, এখন মাদক কিনতে বেশী কষ্ট করতে হয় না। ফোন দিলেই মাদক মিলে যায়। কারন জানতে চাইলে ঐ মাদকসেবী বলেন, এখন তো আর পুলিশ নেই। সবাই স্বাধীন ভাবে ব্যবসা করতে পারছে। তাই মাদক ব্যবসায়ীরাও স্বাধীনতা পেয়েছে। আমাদের জন্য ভালোই হয়েছে। মিরপুর উপজেলার বহলবাড়িয়ার অটো চালক টিপু বলেন, মিরপুর বহলবাড়িয়া সড়কের সাতবাড়িয়া মাঠে প্রায়ই ডাকাতি হয়। সন্ধ্যা হলে ডাকাত এর আতঙ্কে ঐ রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না। প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ডাকাতি ও ছিনতাই এর ঘটনা ঘটে।
আমরা চাই পুলিশ এসব সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনুক। তা না হলে উপজেলায় দিনে দিনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তাতে সন্ধ্যার পরে কোন রাস্তাতে বের হওয়া যাবে না। বহলবাড়িয়া ইউনিয়নের সুতা ব্যবসায়ী সাদেক বলেন, বর্তমানে আমাদের এলাকাতে চুরির ঘটনা অনেক বেড়ে গেছে। বাহিরে সুতা মেলতেই পারিনা। রাত হলেই চোরদের আনাগোনা বেড়ে যায়। থানার পুলিশ তো আর বাহিরে আসেনা। তাই রাতে চোররাই বাহিরে রাজত্ব করে। আমরা এই অবস্থার প্রতিকার চাই। নয়মাইল কাছারির বাসিন্দা সেঁতেরা বেগম বলেন, দেখতেই তো পারছেন আমাদের এখানের অবস্থা। দিনের আলোতে সন্ত্রাসীরা লুটপাট করে নিয়ে যায়। আর রাতের অন্ধারে চুরি। এসব সন্ত্রাসীদের কিছু বলার নেই। পুলিশ থাকা না থাকা এখন সমান হয়ে গেছে। আমরা চাই পুলিশ যেন আরো কঠোরভাবে এসব অপরাধীতে দমনের কাজ করে। মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা শাহজামাল বলেন, এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও মাদকের ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট। বাড়ীর সামনে দিন রাত ২৪ ঘন্টা চলছে মাদক বিক্রি । আগে মাঝে মাঝে পুলিশের অভিযান থাকলেও ৫ আগষ্টের পর থেকে পুলিশের নেই কোন তৎপরতা। আমাদের তো মনে হয় থানাতে কোন পুলিশ নেই। পুলিশ কেন তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিলো তা জানা নেই। আমাদের চাওয়া দ্রুত যেন এসব অপরাধীদেরকে ধরে আইনের আওতায় আনা হয়।
মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের ভ্যান চালক জসিম বলেন, এলাকায় চোরের যন্ত্রণায় আমরা সবাই অতিষ্ঠ। আমি গত এক মাস আগে কিস্তি তুলে আমার ভ্যানের জন্য দুইটি নতুন ব্যাটারি কিনে আনি। দুইদিন পরে আমার বাড়ি থেকে সেই ব্যাটারি চুরি হয়ে যায়। বর্তমানে চোরেরা পুলিশকে ভয় পায় না। পুলিশও আগের মত আর ডিউটি করে না। তাই দিন দিন চুরি ও ডাকাতির মতো ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা সাধারণ মানুষ এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ চাই। মিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মমিনুল ইসলাম বলেন, উপজেলায় যে সব চুরির ঘটনায় ঘটেছে সেগুলো কিছু আমরা ধরেছি এবং বাকি গুলোদের ধরার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি। চুরি ও মাদকের বিষয় আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে কাজ করছি। আমার যতটুকু ক্ষমতার রয়েছে তা দিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা বসে নেই, প্রতিনিয়ত কাজ করছি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) পলাশ কান্তি নাথ বলেন, এই বিষয়ে কোন ডাটা না থাকায় আমি কিছু বলতে পারছি না। যে সকল এলাকায় চুরি, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসা হচ্ছে এ বিষয়ে আপনারা প্রথমে থানার ওসিকে জানান, তরপর সেখানে পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে কিনা দেখেন। যদি পুলিশ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে আমাদের নলেজে দিন। কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান এর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি কল রিসিভ করেন নাই।
