ভেড়ামারা প্রতিনিধি ॥ গতকাল শনিবার (১৬ মার্চ) সকাল ১১টার সময় কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের মাধবপুর মাদ্রাসা মাঠে গত রবিবার ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রায় অর্ধকোটি টাকার পানবরজ পুড়ে ছাই হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকদের মাঝে রমজানের সামগ্রী ও ঈদ উপহার হিসেবে সোলা,মুড়ি, সিমাই, চিনি, চাল, ডাল ,আলু, লবণ ও সোয়াবিন তেলসহ ও বস্ত্র সামগ্রী শাড়ী-লুঙ্গি ৫শ’পান চাষী পরিবারদের মধ্যে বিতরণ করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া ২ আসনের এমপি জনাব মাহবুব উল আলম হানিফ। সেই সাথে ৫শ’জন নারী-পূরুষ চাষীদেরকে নগদ ২হাজার করে মোট ১০ লক্ষ টাকা বিতরণ করেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফার থেকে বিরত রাখতে সরকার ইতিমধ্যে বাজার নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়েছে। সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে অনেকটাই কমে এসেছে দ্রব্যমুল্যের বাজার বলেও জানান হানিফ। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ পান চাষীদের উদ্দেশ্যে আরো বলেন,আপনাদের ৪ পার্সেন্ট সুদহারে ব্যাংক থেকে কার্ড করে কৃষি ঋণ অচিরেই দেওয়া হবে। যে সমস্ত চাষীরা বিভিন্ন এনজিও সমিতি থেকে লোন নিয়েছেন, তাদের কে বলছি, আপনারা আগামী ৪মাস কোন কিস্তি দয়া করে নিবেন না। জমির মালিকদের কে বলছি, বরগা চাষীর কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা জমির খাজনা নিবেন না। দুর দুরান্তে বড় ব্যবসায়ীরা যারা এই অঞ্চলের পান বরজের উপর অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছেন তারা ৬মাস ১ বছর পর টাকা নিবেন। উল্লেখ্য, কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার পল্লীতে বাহাদুরপুর-রায়টা নামক এলাকা থেকে সাড়ে ৩ কিলো মিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পরা স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেছে ভেড়ামারা তথা গোটা দেশ। প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা ধরে জ্বলা পান বরজ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রায় ৯২ হেক্টর জমির উপর সাড়ে ৮শ’কৃষকের মোট ১৩শ’৪৩টি পান বরজ পুড়ে চাই। নিঃস্ব হয়ে গেছেন এই এলাকার পান চাষীরা । মাঠের পর মাঠ এখন শুধুই ধ্বংসস্তুপ। কোথাও ছাই বা কোথাও পোড়া পানগাছ কঙ্কাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে পোড়াগন্ধ আর ক্ষতিগ্রস্তদের আহাজারি। চোখের সামনে সবকিছু হারিয়ে বাকরুদ্ধ অনেক পানচাষী পরিবার। তাদের কে সরকারী ভাবে সহায়তা হিসেবে এই প্রনোদনা দেওয়া হয়। এই সময় আরও উপস্থিত ছিলেন,কুষ্টিয়া-২ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কামারুল আরেফিন, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক এহতেশাম রেজা, ভেড়ামারা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী আক্তারুজ্জামান মিঠু, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আকাশ কুমার কুন্ডু, ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব রফিকুল আলম চুনু, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু হেনা মোস্তফা কামাল মুকুল, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আজিজ, বাহাদুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন। উপজেলা পিআই ও কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ । কৃষি অফিসার মাহমুদা সুলতানা প্রমূখ। গত রবিবার (১০ মার্চ) সকাল ১১টার সময় উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের রায়টা পাথরঘাট এলাকার মিলনের পানের বরজ থেকে আগুনের সূত্রপাত। ইউনিয়নের পদ্মা নদী-তীরবর্তী রায়টা, নিশ্চিন্দ্রপুরপাড়া, আড়কান্দি, মাধবপুর, গোসাইপাড়া ও মালি পাড়া গ্রামের বরজে আগুন লাগে। প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভেড়ামারা ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর , দৌলতপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঈশ্বরদী উপজেলার ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২টি ইউনিট এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তবে কীভাবে আগুনের সূত্রপাত সেটা জানা যায়নি। এই অগ্নিকান্ডে কয়েক হাজার বরজ পুড়ে যায় ঐদিন। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষিদের মধ্যে জুয়েল রানা, ছোটন, চানদেরা খাতুন, রাসেল, সিরাজুল, সেলিম, আসলাম উদ্দিন, আবুল হোসেন, আশরাফ, ইনামুল, মুক্তার, মন্টু সরদার, আমিন উদ্দিন, আবদুল হান্নান ও আমিন প্রামাণিক বলেন, আমরা সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনের রাস্তা এই পান বরজ। তাও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। আমরা অনেকেই বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ ও ধারদেনা করে পান চাষ করেছিলাম। এখন কীভাবে আমরা ঋণ শোধ করব বা আবার ক্ষতিগ্রস্ত বরজগুলো কীভাবে মেরামত করব, তা ভেবে পাচ্ছি না। এ অবস্থায় সরকারিভাবে কিছুটা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হলে পুনরায় আমরা বরজ তৈরি করে পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারতাম। আমরা সহায়তা নয়,সহজ কিস্তিতে ঋণ চাই। পানচাষি আসলাম উদ্দিন বলেন, আমার ১২ বিঘা জমিতে পান ছিল। পানের বরজ আগুনে না পুড়ে আমার বসতবাড়ি পুড়ে গেলেও এত কষ্ট পেতাম না। বরজ থেকে আয় দিয়েই আমাদের সংসার চলে। এখন আমি পরিবারের দুই বেলা খাবার কীভাবে জোগাড় করব! পানচাষি রকিবুল ইসলাম বলেন, বরজের পান দুই মাস পর বিক্রি করেই মেয়ের বিয়ে দেব বলে দেখাশোনা করছিলাম। এখন বিয়ে তো দূরের কথা, কীভাবে সংসার চালাব ভেবে পাচ্ছি না। ভেড়ামারা পানচাষি সমিতির সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, আগুন চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকান্ডে দুই হাজারের বেশি পানচাষির কয়েক হাজার বরজ পুড়ে গেছে। দুই মাস পরেই বরজ থেকে পান ভাঙা শুরু হতো। চাষিরা এত বড় ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেবে? কয়েকশ চাষি ১২ বিঘা, ১০, ৫ বিঘা জমিতে পান চাষ করেছিলেন। এ ছাড়া বরজে শ্রমিকরা প্রতিদিন হাজিরা ভিত্তিতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এই অগ্নিকান্ডে তাদের পরিবারেও দুর্দশা নেমে এলো। সরকারের তরফ থেকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত পানচাষিদের জন্য সহায়তা কামনা করছি। বাহাদুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোহেল রানা পবন বলেন, অগ্নিকান্ডে পানচাষিদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের অর্থনীতি নির্ভর করে পান চাষের ওপর। এই ক্ষতি সহজে পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। তাই ক্ষতিগ্রস্তদের দ্রুত আরও সরকারি সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন।
