বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাবা-মায়ের নামে ভবন করার নামে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ ফান্ডের কোটি কোটি লোপাট করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও তার ভাই সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা। দ্বিতল ভবন নির্মাণ করতে বাজার দরের বাইরে কয়েকগুন বেশি অর্থ খরচের অভিযোগ উঠেছে। হানিফ প্রভাব খাটিয়ে তার মা রহিমা ও পিতা আফসারের নামে রহিমা-আফসার একাডেমিক ভবন নির্মাণ করেছেন ইসলামিয়া কলেজে।
আর কাজের ঠিকাদার নিযুক্ত করেন নিজের চাচাত ভাই আতাউর রহমান আতাকে। আর সম্পর্কে ভাগ্নে শামসুর রহমান বাবু নামের একজনকে সভাপতি করেন হানিফ। ভাগ্নে ও ভাইয়ের সহযোগিতায় ফোকলা করেছেন কলেজের ফান্ড। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে ভবন নির্মানে অনিয়ম ও অর্থ তছরুপ পেয়ে অবসরে যাওয়া অধ্যক্ষ নাওয়াব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এছাড়া আতার বিরুদ্ধেও তদন্ত চলমান আছে। এছাড়া নানা অনিয়ম দুর্নীতি জড়িত থাকায় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলামের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
কলেজের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশন সুত্রে জানা গেছে, ‘ইসলামিয়া কলেজের ভবন সংকট থাকায় নতুন একাডেমিক ভবন করার সিদ্ধান্ত নেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে রেল লাইন সংলগ্ন কলেজের জায়গায় ভবনটি নির্মানের নকশা প্রস্তুত করা হয়। ভবনটি নির্মানের জন্য সরকারি অনুদান প্রাপ্তির জন্য শিক্ষকরা হানিফের দারস্ত হলেও তিনি কলেজ ফান্ডের টাকা দিয়ে ভবন নির্মানের নির্দেশ দেন। সেই মোতাবেক কলেজ ফান্ডের অর্থ দিয়ে ভবন করার সিদ্ধান্ত নেয় পরিচালনা পর্ষদ। হানিফ ভবনটির নামকরণ তার মা-বাবার নামে করার জন্যও পরামর্শ দেয়।
দরপত্র আহবান করা হলে দুটি প্রতিষ্ঠান কাজে অংশ নেওয়ার জন্য সিডিউল ক্রয় করে। একটি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হলেও তাকে কাজ না দিয়ে আতাউর রহমান আতার প্রতিষ্ঠান গ্যালাক্সিকে কাজ দেয় কলেজ কমিটি। নথিপত্র ঘেটে দেখা গেছে, এমপিও ভুক্তি হলেও ভবনটি নির্মানে ফাউন্ডেশন, নীচতলা ও দোতলার কাজ হলেও ডিজাইন, প্রাক্কলন ও টেন্ডার সংক্রান্ত কোন কাজের প্রশাসনিক অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এক প্রকৌশলীকে ২০ হাজার টাকা বেতনে রাখা হয়।
পাশাপাশি অধ্যক্ষের পছন্দের প্রতিষ্ঠান মাসকান এম্পেস সলুশন নামের প্রতিষ্ঠানকে। কাজ শুরুর আগে ২৬ লাখ ১৪ হাজার ২০৭ টাকা বিভিন্ন খাতে খরচ দেখানো হয়। আর প্রাক্কলন তৈরির সময় নির্ধারিত বাজার দরের কয়েকগুন বেশি অর্থ ব্যায় ধরা হয়, যা তদন্তে উঠে এসেছে। কাজ শুরুর আগেই ঠিকাদার আতাকে আগাম অর্থ দিয়ে দেওয়ার মত ঘটনাও আছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কলেজ ফান্ড থেকে আতাকে গাউন্ড ফ্লোর ও প্রথম তলার কাজের জন্য দেওয়া হয় ৩ কোটি ৩১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৬৩ টাকা আর পরে অর্থ বছরে দেওয়া হয়েছে ২ কোটি ৮৪ লাখ ১২ হাজার ৭৮৭ টাকা।
কাজটি দুই বছরের মধ্যে শেষ চলতি বছরের প্রথম দিকে কিছু কাজ বাকি রেখেই তড়িঘড়ি হস্তান্তর করা হয়। এরপর ছাদের কিছু অংশ ধ্বসে পড়ে। পরে তা আবার ঠিক করা হয়েছে। ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকার বাইরেও আতা অতিরিক্ত ব্যায় দেখিয়ে আরো কোটি কোটির বেশি তুলে নিয়েছেন কলেজ ফান্ড থেকে। দুদক তার প্রতিবেদনে কলেজ ফান্ডের অর্থ খরচের বিষয়ে আর্থিক বিধিবিধান লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিপুল পরিমান অর্থ তছরুপের বিষয়টি প্রাথমিক ভাবে প্রতীয়মান হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি কলেজের সভাপতি ও অধ্যক্ষকে দায়ী করা হয়েছে। কলেজের দুই সহকারি অধ্যাপক জানান, হানিফের কথা মত সব হয়েছে। এসব কারনে ভবন নির্মানে কলেজ ফান্ডের কোটি কোটি টাকা তছরুফ হলেও কেউ কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পাইনি। এ টাকা নিয়ে গেছে হানিফ ও আতাসহ কয়েকজন। এর সাথে সাবেক পরিচালনা পর্ষদ সদস্য সিরাজুল ইসলামও জড়িত আছে। একটি চক্র মিলে এসব কাজ করেছে। আতা সর্বশেষ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম দলবল নিয়ে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাড়িতে যান।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, মুল ভবনের কাজ শেষ হলেও অনেক কাজ এখনো বাকি। দরজা-জানালার কাজ শেষ হয়নি। ইলেকট্রিকসহ অন্য জরুরী কাজও পড়ে আছে। এই অবস্থায় জায়গা সংকট থাকলেও কোটি টাকার ভবনটি কোন কাজে আসছে না। সর্বশেষ সপ্তাহ খানেক আগে নতুন এ ভবন থেকে ৫০টির মত সিলিং ফ্যান চুরি হয়ে গেছে। থানাপাড়ার কয়েকজন ব্যাক্তি এ চুরির সাথে জড়িত বলে জানা গেছে। কলেজের দুইজন সিনিয়র সহকারি অধ্যাপক জানান, দরপত্র দেওয়ার সময় সরকারি কোন নিয়মনীতি মানা হয়নি। প্রতিযোগিতামুলক না হওয়ায় হানিফের ভাই আতা কাজটি পেয়ে যায়। সভাপতি ও তৎকালিন অধ্যক্ষ হানিফকে খুশি রাখতে নিয়মের ব্যাতয় ঘটিয়ে কাজটি আতাকে পাইয়ে দেন। এ জন্য তারাও মোটা অঙ্কের অর্থ নেন ফান্ড থেকে।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের একজন সহকারি প্রকৌশলী বলেন, এ কাজে যথাযথ নিময় মানা হয়নি। কয়েকগুন বেশি অর্থ খরচ হয়েছে। কাজের মান যাচাই করা হয়নি। এখানে কলেজের স্বার্থের চাইতে ব্যাক্তির স্বার্থ দেখা হেয়েছে মনে হচ্ছে। প্রতিযোগিতামুলক হলে কাজটি করতে কলেজ ফান্ডের অর্ধেক অর্থ সাশ্রয় হতো। কলেজের দুই স্টাফ জানান, নাওয়াব আলী অবসরে যাওয়ার আগেও কাজ বাকি ছিল ভবনের। নাওয়াব আলীর বিরুদ্ধে দুদক তদন্ত শুরু করার পর তিনি বাঁচতে তৎকালিন সভাপতি শামসুর রহমানে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে নিজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে নিজের পছন্দের হাবিবুল ইসলামকে নিয়োগ দেন।
হাবিবুল ইসলাম এসে ঠিকাদার আতার শেষ কিস্তির প্রায় কোটি টাকার মত বিল আটকে দেন। পরে হাবিবুলের যোগসাজসে সেই বিলের একটি অংশ তুলে নেন আতা। দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত কুষ্টিয়া কার্যালয়ের সহকারি পরিচালক নীল কমল পাল বলেন,‘ তদন্ত করে ভবন নির্মানে অতিরিক্ত ব্যায় ও ভুয়া বিলের বিষয়টি ধরা পড়ে। এছাড়া টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কাজেও অনিয়ম হয়েছিল। এসব কারনে অধ্যক্ষ নাওয়াব আলীর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
মামলাটি চলমান আছে। সাবেক সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, নিময় মেনে তারা কাজ করার চেষ্টা করেছিলেন। ঠিকাদারের কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য অধ্যক্ষসহ অন্য লোক দায়িত্ব ছিলেন। তারা যদি কাজ বুঝে না নেই সেই দায় তাদের। বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হাবিবুল ইসলাম বলেন, আমি আসার পর একটি বিল দিয়েছি। তারপরও আরও ঠিকাদার আরো অর্থ পাবে জানিয়ে বিল দাখিল করেছে। সেই বিল এখনো দেওয়া হয়নি। ৬টি রুম আমরা ঠিক করে পরীক্ষা নেওয়ার কাজ করছি। বাকি কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।
