জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র রহস্যময় অন্তীম যাত্রা
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা মোল্লাতেঘরিয়া মোল্লাপাড়ার ওয়াহিদুল ইসলামের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (তুলি) । ২২ আগষ্ট ছিলো জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র জন্মদিন । অথচ গত মঙ্গলবার ২২ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনের গলির মফিজউদ্দিন লেনের একটি বাড়ীর ফ্লাট থেকে টেনে হিচড়ে নামানো হয় জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র মরদেহ, নাকি জীবিত জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’কে । মরদেহ, নাকি জীবিত তা পরিস্কার হতে বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়নি জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র পরিবারকে । কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে পৌঁছানোর পর কর্তব্যরত ডাক্তার জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’কে দেখা মাত্রই মৃত বলে ঘোষনা করেন ।

জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র রহস্যময় অন্তীম যাত্রা
কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র পরিবারের পুরুষ কোন সদস্য ঐ সময় পর্যন্ত না পৌঁছালেও হাসপাতালের জরুরী বিভাগের পাশেই তালা বন্দী মৃতদেহের কাছে বুক চাপড়িয়ে আহাজারি করছে জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র মা ও বোন । হাসপাতালের কর্তব্যরত নার্সরা তাদের সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তাদের সকল চেষ্টা বৃথা হয়ে যাচ্ছে ।
তার অল্পকিছুক্ষণ পরেই হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরের কর্মির আগমনে আহাজারির মাত্রা আরো কয়েগুণ বেড়ে যায় জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র মা ও বোনের । অবশ্য এই সময়ের মধ্যে পরিবারের আরো বেশ কয়েকজন হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয়েছিলো । পুলিশের উপস্থিতিতে তালা খুলে লাশ কাটা ঘরে নেওয়া প্রস্তুতি প্রায় শেষ মূহুর্তে । জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র লাশ সংরক্ষিত ট্রলি টান দিতেই বড় বোন শেষবার তার মুখটা দেখার জন্য কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কর্তব্যরত নার্সদের একটি ছবি তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করে এবং ছবি তোলা শেষে তুলি’র লাশ সংরক্ষিত ট্রলি চলতে থাকে মর্গের দিকে । যেখানে তুলি’র লাশ আপাতত রাখা হবে । পরের দিন অর্থাৎ বুধবার কাটা হবে তুলি’র লাশ । মাত্র তিন থেকে পাঁচ মিনিটের রাস্তা সদর হাসপাতালের জরুরী বিভাগ থেকে লাশ কাটা ঘর । ট্রলি দিয়ে টেনে নেওয়া হচ্ছে তার লাশ, আর পিছন পিছনে ভারী পায়ে আহাজারী করে ছুটে চলেছে তার মা ও বোন । লাশ পৌঁছে গেলো লাশ কাটা ঘরে । কিচুক্ষণ পরে সেই ঘরেও দেওয়া হলো তালা ঝুঁলিয়ে । ঘরের মধ্যে ট্রলির উপরে পড়ে থাকলো তুলি’র নিথর মরদেহ । এরপর এক এক করে আরো স্বজনেরা আসলো লাশ কাটা ঘরের সামনে । তালাবন্ধ লাশ কাটা ঘর আর তুলি’র পরিবারের দূরত্ব তখন পরিমাপ অযোগ্য ।
বিকেল পাঁচটার পর লাশ কাটা ঘর থেকে কেউ বেরহতে পারে না । হাসপাতালের নিয়ম অনুসারে পর দিন নূন্যতম সকাল ১০ টা পর্যন্ত কোলাহল মুক্ত লাশ কাটা ঘরেই লাশের ঠিকানা হয় । তুলি’র ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি । পর দিন দুপুরের পরে লাশ কাটা ঘর থেকে তুলি’র লাশ বের হয়, লাশ কাটা ঘরে ঠাই পাওয়া সবার সাথে যা হয়, তুলি’র সাথেও তাই হয়েছিলো । এর পর সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ তুলি’কে হস্তান্তর করা হয় পরিবারের নিকট । তুলি’র এই মরণ যাত্রায় সময় লেগেছিলো ৩১ ঘন্টা । জানাযা এবং দাফন সহ আরো কয়েক ঘন্টা ।
তুলি’র পরিবারের ভাষ্যমতে বাড়ী থেকে বিয়ের কথা বললেও বিয়ে করতে রাজি ছিলো না তুলি । পরিবারের লোকজন হয়তো ধরণা করতে পারেনি বা জানতে পারেনি তুলি’র প্রাইভেট টিউটর ”কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার চক দৌলতপুর গ্রামের মৃত তক্কেল আলী’র পুত্র পেশায় আইনজীবী মাহমুদুল হাসান সুমনের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠে ছিলো তার । আর সব প্রেমের সম্পর্কের মত তাদের মধ্যেও হয় কথা হয়েছিলো সারাজীবণ এক সাথে, এক ছাদের নীচে সুখে-দূঃখে কাটিয়ে দেওয়ার । আর যেই কথা ও স্বপ্ন গুলো হয়তো অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলো তুলি । কিন্তু মিথ্যা সেই স্বপ্ন এবং কথাই তুলি’কে নিয়ে গেল অন্তিম যাত্রায় আর রেখে গেলো অজানা রহস্য আর অগণিত প্রশ্ন ।

কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনের গলির মফিজউদ্দিন লেনের মাহমুদুল হাসান সুমনের যে ভাড়া ফ্লাট থেকে জীবিত অথবা মৃত জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’র দেহ কয়েকজন মিলে টেনে হিচড়ে নামানো হয়েছিলো, সেই বাসা মাহমুদুল হাসান সুমন ভাড়া নিয়ে ছিলো মাত্র দিন দশেক আগে । ফ্লাটের মালিককে বলেছিলেন বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকবেন তিনি । কথা মত নব্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে ১৮ আগস্ট ফ্লাটে উঠেন মাহমুদুল । কিন্ত মাহমুদুলের স্ত্রী হিসাবে তুলি ছিলো না । মাহমুদুলের স্ত্রী ছিলো কুষ্টিয়া হরিপুরের শালদহ গ্রামের এশা ইমরোজ ।
মাহমুদুল হাসান সুমনের বাসা বদল থেকে বিয়ে, সব কিছুই ছিলো পূর্ব পরিকল্পিত । তাই বাসা বদল বা বিয়ের খবর হয়তো জানতো না জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি । তাই হয়তো তুলি হন্নি হয়ে বেশ কয়েকদিন যাবত মাহমুদুল হাসান সুমনের বাসাও খুঁজেছেন । তারই ধারাবাহিকতায় বাসার ঠিকানাও পেয়েছিলেন । তাই সে সিদ্ধান্ত নেয়, সেদিন (২২ আগস্ট) সে মাহমুদুলের বাসায় যাবে। দুপুরের কড়া রোদ যখন পশ্চিমে হেলেছে, এমন একটা সময়ে পৌছে যায় জান্নাত কুষ্টিয়া জেলা স্কুলের সামনে মফিজউদ্দিন লেনের একটি বাড়ীর সামনে। ঐ বাড়ীরই তৃতীয় তলায় মাহমুদুল নববধুকে নিয়ে বসবাস করছে। পাঁচ তলা এই ফ্লাট বাড়ীটির মালিক গোলাম নবী ও মিতা দম্পত্তি। প্রতি বছরের মত হয়তো জন্মদিনের উপহার হাতে মাহমুদুলকে দেখার চরম ইচ্ছে ছিল তার। সেদিন দেখা হয়েছিলো তুলি’র সাথে মাহমুদুলের, কিন্তু ইচ্ছা পূরণ হয়েছিলো কিনা বলা কঠিন । বাড়ীর মূল ফটকে পেীঁছানোর পর নীল জামা পরিহিত ১২/১৩ বছরের একটা ছেলে জান্নাতকে ভবনের মেইন গেট খুলে ভেতরে যেতে সহায়তা করে। এরপর ঘটনা তৃতীয় তলায়। দরজা নক করে খুলে দেবার সাথে সাথে জান্নাত ভেতরে ঢুকে পড়ে। মাহমুদুল তখন নির্বাক, তার স্ত্রী আশ্চর্য হয়ে যায়। জান্নাত তার স্ত্রী এশা ইমরোজ সামনের বার বার মাহমুদুলের অঙ্গীকারের কথা বলতে থাকে। মাহমুদুল তিক্তবিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। জান্নাত তখন ভবনের ছাদে চলে যায় আবারো যাবার অপেক্ষা করতে থাকে। এর মাঝে মাহমুদুল ও তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়ার মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বার বার জান্নাত প্রসঙ্গে জানতে চায়, কতদিনের সম্পর্ক, কিভাবে সম্পর্ক, মেলামেশা করেছে কিনা, তাহলে আমাকে কেনো বিয়ে করলে ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে বাড়ীওয়ালা গোলাম নবীর স্ত্রী মিতা খাতুন ছাদে গিয়ে দেখতে পান একজন অপরিচিত মেয়ে সেখানে ঘুরাঘুরি করছে। তখন সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটা মত। কোথায় এসেছে জানতে চাইলে জান্নাত জানায়, তিনতলার ভাড়াটিটয়া মাহমুদুলের বাসায় এসেছে এবং তারপরই সেখান থেকে নেমে আসে।
জান্নাত নেমে এসে আবার দরজা নক করে এবার মাহমুদুলের স্ত্রী দরজা খুলে দেন এবং জান্নাতকে ভেতরে নিয়ে যায়। সেসময় জান্নাতকে বাজে ভাষায় অকথ্য ভাবে কথা বলা হয়। এই অপমান সে সহ্য করতে না পেরে একটা রুমে ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। তখনো মাহমুদুল ও তার স্ত্রীর মাঝে তুমুল ঝগড়া চলছে। জান্নাত ঐ ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করার চাইতে জান্নাতের সাথে মাহমুদুলের সম্পর্কের বিষয়টা বেশি গুরুত্ব পেতে থাকে। বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলে ঐ ঘর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা ধাক্কা দিতে থাকে, তখনো কোনো সাড়া না পেয়ে শেষে ৯৯৯ কল করে মাহমুদুল। । সাথে সাথে মাহমুদুল কুষ্টিয়া কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের বিষয়টি জানান। এরপর মহিলা পুলিশ ছাড়াই ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে এবং একই সময় বারের নেতারাও আসেন। পুলিশ এসে দরজা ভেঙ্গে ঢোকে এবং জান্নাতকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে সেখান থেকে উদ্ধার করে, স্থানীয়দের সহয়তায় চ্যাংগোলা করে তিনতলা থেকে লাশ নিচে নামায়, তখনো কোন পুলিশ লাশের সাথে ছিল না। একজন নারী ঘরের মধ্যে দরজা আটকিয়ে খুলছে না এমন তথ্যের ভিত্তিতে মহিলা পুলিশ ছাড়া সেখানে কিভাবে পুলিশ যেতে পারে! একজন নারীর সুরতহাল তৈরীর জন্য একজন মহিলা দারোগারও প্রয়োজন হতে পারে। লাশ নিচে নামানোর পর বেশ অনেক সময় পুলিশের সাথে মাহমুদুলের বাসায় কি কথা বার্তা হয়েছে তা জানা যায়নি। তারপরও প্রাথমিক ধারনায় পুলিশ এটাকে আত্মহত্যা বলে উল্লেখ করেছে।
এই ঘটনার পর জান্নাতের মার আহাজারি সকলের নজরে পড়ে, শরিফা খাতুন উপস্থিত সকলের সামনে চিৎকার করে বলতে থাকেন ‘আমার মেয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে সে কখনো আত্মহত্যা করতে পারে না, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, আমি এর বিচার চাই’। তিনি জানান, ‘সকাল আটটায় বাড়ী থেকে ১০০ টাকা নিয়ে বের হয়, আজ তার জন্মদিন তাই বান্ধবীদের সাথে ঘুরবে। সন্ধায় আমার বড় জামাই মিশুক আলীকে ফোন করে ঐ উকিল জানায়, আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে’। সে সময় জান্নাতের বড় বোন তাসনিমও মায়ের সাথে ছিলেন।
ময়না তদন্ত শেষে হয়েছে জান্নাতের, বিস্তরিত আরো তথ্য জানা যাবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট আসার পরে । তবে জান্নাতের মা, বোন ও স্বজনদের দেওয়া তথ্য মতে প্রচন্ড পরিমাপের ধার্মিক জান্নাত যার সমস্ত শরীর বোরখায় ঢাকা এমন কি হাতেও মোজা পরা। এই ধরনের নারী আত্মহত্যার মত পাপ করবে এটা জান্নাতের স্বজনরা মোটেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ঘটনার পর থেকে সাংবাদিকরা অনেক যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও মাহমুদুলের সাথে সংযুক্ত হতে পারে নাই। অনেকে ধারনা করছে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আত্মগোপন করেছেন।
অনেকেই বলছে বিবাহর প্রতিশ্রুতি দিয়ে দৈহিক মিলনের ফলে জান্নাত অন্তঃসত্ত্বাও হতে পারে। সেই লজ্জায় সে এই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। জান্নাত একজন প্রতিভাবতী নারী ছিলেন, জীবনটাকে মানুষের সেবার নিয়োজিত করার লক্ষে নার্সিং শিক্ষায় শিক্ষা নিতে শুরু করেছিল। তিনি কুষ্টিয়া নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলো। এখন হয়তো জান্নাত জান্নাতের পথে যাত্রা নিয়ে নতুন যুদ্ধে লিপ্ত ।
বুধবার বাদ মাগবির চাঁদাগড়া মাঠ কবরস্থানে জানাযা শেষে হাউজিং কবরস্থানে জান্নাতুল ফেরদৌস তুলি’কে দাফন করা হয় ।
