বাংলার ইতিহাসে এমন কিছু চরিত্র আছে, যাদের নাম সময়ের ধুলায় প্রায় মুছে গেছে, অথচ তাঁদের ত্যাগ, সাহস ও দেশপ্রেম এককালের সম্পূর্ণ যুগকে আলোকিত করেছিল। প্যারীসুন্দরী দেবী তাঁদেরই একজন — নীল বিদ্রোহের অগ্নিসংগ্রামে যিনি কেবল এক নারী হিসেবেই নয়, বরং এক অদম্য দেশপ্রেমিক ও প্রতিবাদী নেতৃত্ব হিসেবে নিজের স্থান নিশ্চিত করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার নদীয়া জেলার (বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার সদরপুর) জমিদার রামানন্দ সিংহের কনিষ্ঠ কন্যা প্যারীসুন্দরী দেবী আজও বাঙালির স্মৃতিতে অবিচ্ছিন্ন এক কিংবদন্তি।
তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন কুখ্যাত নীলকর টমাস আইভান কেনি (T.I. Kenny)—ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাপুটে ইউরোপীয় নীল চাষী। কেনির অত্যাচার, প্যারীর প্রতিবাদ, এবং সেই প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলায়, যা পরিণত হয়েছিল নীল বিদ্রোহ নামে এক ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে।

প্যারীসুন্দরী দেবী ছিলেন জমিদার পরিবারে জন্ম নেওয়া এক শিক্ষিত ও দৃঢ়চেতা নারী। তাঁর পিতা রামানন্দ সিংহ ছিলেন প্রজাদরদি ও সংস্কৃতিমনা জমিদার।
তবে জমিদারি জীবনের আরাম-আয়েশ তাঁকে আকর্ষণ করেনি। বরং তিনি বড় হয়েছেন মানুষের পাশে থাকার মানসে।
নীলকরের অত্যাচার যখন ক্রমে সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন প্যারীসুন্দরী দেবী হয়ে ওঠেন কৃষক ও প্রজাদের শেষ আশ্রয়। কেনি ও তার অনুচরেরা জোরপূর্বক নীল চাষ চাপিয়ে দিচ্ছিলেন ধানক্ষেতের ওপর। কৃষকেরা দিনরাত নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন—পোড়ানো হচ্ছিল ঘর, ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছিল ফসল।
অসহায় মানুষগুলো এক এক করে এসে দাঁড়ায় সদরপুর জমিদারির কুঠির সামনে—প্যারীসুন্দরীর দ্বারপ্রান্তে।
তিনি শুনলেন, বুঝলেন, এবং বললেন—
“এই অন্যায়ের জবাব দিতে হবে। আমরা আমাদের মাটির অধিকার ফিরিয়ে নেব।”
এই একটি বাক্যই ছিল বিদ্রোহের সূচনা।

টমাস আইভান কেনি, সংক্ষেপে টি.আই. কেনি, ছিলেন কুষ্টিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে কুখ্যাত নীলকর। তাঁর কাচারি ছিল কুষ্টিয়া শহরের বেকি দালানে, আর প্রধান কুঠি ছিল শালঘর মধুয়া এলাকায়। ইংরেজ প্রশাসনের ছত্রছায়ায় তিনি স্থানীয় কৃষকদের জমি দখল করে জোর করে নীল চাষ করাতেন।
প্যারীসুন্দরী দেবী একদিকে প্রজাদের ক্ষোভ শুনছেন, অন্যদিকে দেখছেন কেনির প্রতারণা। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন প্রতিরোধের। নিজের নায়েব রামলোচন-এর সহায়তায় সংগঠিত করলেন লাঠিয়াল বাহিনী। গ্রামের কৃষক, কামার, কুমার, মাঝি—সবাই যুক্ত হল এই প্রতিরোধে।
প্রথম সংঘর্ষ হয় ভাড়ল–পোড়াদহ অঞ্চলে। প্যারীসুন্দরীর বাহিনী প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও, সেটিই ছিল তাঁর যুদ্ধের শুরু। কিছুদিন পর তিনি আবার নতুন কৌশলে আক্রমণ করেন কেনির কুঠিতে। কেনি তখন উপস্থিত না থাকায় প্রাণে রক্ষা পায়, তবে তাঁর স্ত্রী মিসেস কেনি টাকা ছড়িয়ে পালিয়ে যান।

কেনি মামলা করেন প্যারীসুন্দরীর বিরুদ্ধে। কিন্তু ভয় পাওয়ার বদলে প্যারী গর্বভরে বলেন—
“আমার লাঠিয়াল কুঠি লুট করেছে, এই কথা শুনে আমি আনন্দিত। আমি বাঙালির মেয়ে, সাহেবের কুঠি লুটিয়েছি—এতে গর্ব ছাড়া আর কিছুই অনুভব করি না!”
এই উক্তি শুধু এক নারীর সাহসের নয়; এটি ছিল বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক। তিনি কেনির মাথার জন্য ঘোষণা করেন হাজার টাকার পুরস্কার,
আর মিসেস কেনিকে বালা পরিয়ে বাঙালি বধূ সাজানোর অঙ্গীকার করেন।
অন্যদিকে কেনিও প্রতিশোধের হুমকি দেন—
যে প্যারীসুন্দরীকে ধরে আনবে, তাকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, আর প্যারীকে “মেম” সাজিয়ে নিজের কুঠিতে রাখা হবে। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি আক্রমণ, পুরস্কার ঘোষণা, এবং প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে ওঠে সমগ্র অঞ্চল।
এই বিদ্রোহ কেবল প্যারীসুন্দরীর ব্যক্তিগত লড়াই ছিল না; এটি ছিল বাংলার কৃষকসমাজের সামষ্টিক জাগরণ। প্রতি বিঘায় নীল চাষে কৃষকরা দাসে পরিণত হচ্ছিলেন। ১৭,৬০০ বিঘা জমিতে প্রায় ৭০০ মণ নীল উৎপাদিত হতো—এ বিশাল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে যেত, কিন্তু কৃষকরা পেতেন না ন্যায্য মূল্য।
প্যারীসুন্দরীর লড়াই এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক বাস্তব প্রতিবাদ। তাঁর নেতৃত্বে প্রজারা বুঝতে শেখে—ইংরেজ প্রশাসন ও নীলকরের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধই মুক্তির একমাত্র পথ।
প্যারীসুন্দরী শুধু জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন বলে নয়, বরং তাঁর মানবিক নেতৃত্ব তাঁকে অনন্য করেছে।
তাঁর প্রজ্ঞা, সাহস ও রাজনৈতিক বোধ একে নারী স্বাধীনতার প্রাথমিক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
তিনি বলেছিলেন—
“দেশের দুরবস্থা ও নিরীহ প্রজার কান্না শুনে আমার প্রাণ ফেটে যায়। আমি নিজের জীবনের কথা ভাবি না; দেশ ও মানুষের জন্য জীবন দিতে পারলে সেটাই হবে আমার পুণ্য।”
এই ভাবনাই তাঁকে পরিণত করেছিল বাংলার প্রথম কৃষক-নেত্রীদের অন্যতম একজন হিসেবে।
তাঁর নেতৃত্বে প্রজারা অস্ত্র ধরেছিল, কণ্ঠে উঠেছিল প্রতিবাদের ধ্বনি।
কেনির অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রতিরোধের ফলাফল হিসেবে ইংরেজ প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নেয়। তবে প্যারীসুন্দরীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়। প্রহসনের বিচারে তাঁর জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং ইংরেজ সরকার অধিকার করে নেয়। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি।
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে পুনরায় জমিদারি ফিরে পান, যদিও ততদিনে ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে পত্তনি বন্দোবস্তে জমিদারির বৃহৎ অংশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তবুও তিনি ছিলেন অদম্য—দেশ ও মানুষের পাশে থাকা তাঁর জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে ওঠে।
বাংলা সাহিত্যে প্যারীসুন্দরীর নাম উজ্জ্বলভাবে এসেছে।
মীর মশাররফ হোসেন, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ড. আবুল আহসান চৌধুরী—সবাই নিজ নিজ লেখায় তাঁর সংগ্রামী চেতনার কথা উল্লেখ করেছেন।
ড. চৌধুরী লিখেছেন—
“প্যারীসুন্দরী ছিলেন প্রজাদরদী, স্বদেশপ্রাণ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ জননেত্রী।”
অন্যদিকে কেনি পর্যন্ত স্বীকার করেছিলেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব—
“স্ত্রীলোকের মধ্যে প্যারীসুন্দরীর নাম উচ্চারণ করতেও ভয় হয়।”
এই স্বীকারোক্তিই প্রমাণ করে, প্যারীসুন্দরী তাঁর প্রতিপক্ষের কাছেও ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
আজও কুষ্টিয়া শহরের বেকি দালান রোড স্থানীয়দের মুখে পরিচিত ‘কেনি রোড’ নামে। কিন্তু ইতিহাস জানে—এই রোড কেবল কেনির নয়, বরং প্যারীসুন্দরীর সাহসিকতার নিদর্শনও বটে। প্রশ্ন থাকে—এ নামটি স্মরণে আছে ভয়ের কারণে, নাকি শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে?
প্যারীসুন্দরী হয়তো ইতিহাসের পাতায় অচেনা হয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর সংগ্রাম আজও নারীর অধিকার, কৃষকের ন্যায্য দাবি এবং দেশের প্রতি ভালোবাসার চিরন্তন উদাহরণ।

১৮৪৯ থেকে ১৮৬০—এই সময়কাল বাংলার ইতিহাসে ছিল নীল বিদ্রোহের অগ্নিবর্ষা। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতাতেই ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় জোরপূর্বক নীল চাষের নীতি পরিবর্তন করতে। পরের বছর কুষ্টিয়া পায় মহকুমার মর্যাদা, আর বাংলার কৃষকের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় মুক্তির জয়গান।
প্যারীসুন্দরী দেবী শুধু এক নারী নন, তিনি এক যুগের প্রতীক— যিনি প্রমাণ করেছেন, প্রতিরোধের আগুন লিঙ্গ-সীমা মানে না, ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করাই প্রকৃত দেশপ্রেম।
তিনি বাঙালি নারীর সাহসের প্রতিমূর্তি, তিনি বাংলার নীল বিদ্রোহের আত্মা, আর তিনি চিরদিনের জন্য স্বদেশপ্রেমের অনির্বাণ শিখা।
