পদ্মার গতিপথ পরিবর্তন করে পদ্মা আরো আগ্রাসী
বিপন্ন জনপদে ঝুঁকিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অদুরদর্শী, অবহেলা ও অদক্ষতায় দেশের অন্যতম বৃহত্তম পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে। এতে তীরবর্তী কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, মিরপুর, সদর ও কুমারখালী উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ গোটা জনপদ চরম ঝুঁকির মুখে দাঁড়িয়েছে। আক্রান্ত প্রায় ১৫ কি.মি. এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙ্গনে হাজার হাজার বিঘা ফসলি জমি, শত শত বসতভিটা, নানা অবকাঠামো, দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলসহ ও ঢাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী জাতীয় মহাসড়ক ও জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, দেশের বৃহৎ সেচ প্রকল্প গঙ্গা কপোতাক্ষ, ৪১০ মেগা কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্র, হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ, সরকারি বেসরকারি নানা স্থাপনাসহ গোটা জনজীবনই এখন চরম ঝুঁকিতে।

পদ্মার গতিপথ পরিবর্তন করে পদ্মা আরো আগ্রাসী
বিপন্ন জনপদে ঝুঁকিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা
বিষয়টি সকলেই অনুধাবন করলেও মুখ খুলতে চান না কেউ। এ যেন ভাসুরের নাম মুখে না নেয়ার মতো ঘটনা। সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগে বিলম্ব হওয়ায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সরকারের ব্যয়। হার্ডিঞ্জ রেলসেতু ও লালন শাহ সড়ক সেতুর লাগোয়া ভাটিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পের পোর্ট নির্মাণে পদ্মা নদীর বাম তীরে মুল প্রবাহ চ্যানেলের মধ্যে প্রায় ৫শ মিটার দৈর্ঘের গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণের কারণে নদী হারিয়েছে প্রকৃত গতিপথ।
এতে পদ্মা নদীর ডান তীরে দেখা দেয় তীব্র নদী ভাঙ্গন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিশিষ্ট মহল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দায় দিচ্ছেন নদী ও পানিসম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তাদের দাবি শুরুতেই নদীর ডান তীরে মাত্র ২ কি. মি. প্রতিরক্ষা বাঁধ দিলে সুরক্ষিত থাকত নদীর গতি প্রকৃতি ও সমগ্র জনপদ, লাঘব হতো সরকাররের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বোঝা। উদ্ভূত সংকট নিরসনে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে বলে দাবি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষের।
মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হান্নান মণ্ডল অভিযোগ করে বলেন, ‘এ যেন অসহায়ের বোবা কান্নার মতো নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই আমাদের। পদ্মা নদীর বাম তীরে বাঁধ নির্মাণ দেখে ৩ বছর আগে থেকেই আমরা সম্ভাব্য ঝুঁকির আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। আশঙ্কার কথা জানিয়ে আক্রান্ত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ মানব বন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালনের মাধ্যমে সমাধানের দাবি করলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড গুরুত্ব দেয়নি। আজকে যখন সবকিছু শেষ হয়ে গেছে তখন টনক নড়েছে কর্তা ব্যক্তিদের’।
ভেড়ামারা উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ আক্তারুজ্জামান মিঠু জানান, ‘দেশের বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়নে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র আমাদের জন্য আর্শিবাদ। কিন্তু যেসব এক্সপার্টরা এই প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত তাদের আরও সুদুর প্রসারী চিন্তা ভাবনা থাকা জরুরি ছিল। ওইখানে যখন বাধ দিল তখন সেখানে নদীর পানি বাধা পেয়ে কোন জায়গা পর্যন্ত এবং কতখানির এলাকাজুড়ে বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি হবে সেটা নিরূপনসহ তার সমাধান না করেই একচোখা দায়িত্ব পালন করলেন কীভাবে? এ বিষয়টি একজন সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করলেও তারা করলেন না কেনো? শুরুতে যে কাজটি ছোট পরিসরে করলেই সমাধান হতো এখন সেটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকায়’।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও নাগরিক কমিটির সভাপতি ডা. এসএম মুসতানজি বলেন, ‘পদ্মা নদীতে প্রায় দেড়’শ বছর পূর্বে নির্মিত হার্ডিঞ্জ রেল সেতু ও নদীর গতি প্রকৃতি সুরক্ষায় যে প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছিল ওই সময়ের বিশেষজ্ঞরা সেটি আজও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এখানে এমন একটা জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত থাকার পরও আমাদের দেশের এক্সাপার্টরা কেনো বুঝলো না যে, রূপপুর গ্রোয়েন নির্মানের বিরূপ প্রভাবে নদীর গতি প্রকৃতির সম্ভাব্য পরিবর্তন ও তার ভয়াবহতা কী হতে পারে’। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলপথ যানবাহনের জন্য সাধারণত: পানি প্রবাহকে সুরক্ষিত রেখে ফ্লটিং পোর্ট নির্মাণ করে, আমাদের দেশেও আছে, সেই প্রযুক্তি রূপপুর প্রকল্পেও গ্রহণ করা যেতো কি না সেটা ভেবে দেখা যেত’।
স্থানীয় সংসদ সদস্য জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, ‘পদ্মা নদীর বামতীরে রূপপুর বাঁধ নির্মাণের সাথে সম্পৃক্ত বিশেষজ্ঞরা একই সময়ে ডানতীরে সামান্যা কিছু প্রতিরক্ষামূলক কাজ করলেই ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পাওয়া যেতো ভেড়ামারা মিরপুরের বিস্তীর্ণ জনপদ’। তবে দেরিতে হলেও সরকার সমস্যাটি সনাক্ত করে তা সমাধানে প্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ক্ষতি যা হবার তা হয়েছে, নতুন করে আর কোন ক্ষয়ক্ষতি হবে না’।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়ার মরফোলজী বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রইচ উদ্দিন জানান, ‘নানা কারণে নদীর গতি প্রকৃতি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির মধ্যে প্রধান হলো—পানি প্রবাহে বাধাগ্রস্ত হলে ওই পানি যে দিক দিয়ে যাওয়া সুযোগ পাবে সেদিক দিয়েই বয়ে যায়। সেক্ষেত্রে তুলনা মূলক সহজ পথেই পানি ঢুকে পড়ে, এতে নতুন করে পাড় ভেঙ্গে নদী তার প্রয়োজনীয় জায়গা সৃষ্টি করে। বিধি মতে, আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে পদ্মা নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্ত করার কোন সুযোগ নেই। তবে সম্প্রতি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও মিরপুর উপজেলা ঘেষে প্রবাহিত পদ্মা নদী ৪ বছর পূর্বে যে প্রবাহ চ্যানেলে ছিলো এখন সেখানে নেই। বামতীরে গ্রোয়েন (বাঁধ) নির্মাণের কারণে নদী এখন ডানতীর ঘেষে প্রবাহিত হচ্ছে; গুগল ম্যাপ দেখলে সহজেই ধারণা পাওয়া যাবে’।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কুষ্টিয়া অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, ‘পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তনে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনসহ নানা কারণ থাকতে পারে, অনেগুলি কারণের মধ্যে রূপপুর গ্রোয়েনও একটা কারণ। এর বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট সংকট নিরসনে গৃহীত প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। প্রায় ১৫ শ কোটি টাকা প্রাক্কলন ব্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৯ কি.মি. দৈর্ঘের বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তয়ন হলেই সেখানে নদী ভাঙ্গন বন্ধে স্থায়ী সমাধান হয়ে যাবে’। যে কোনো ধরনের উন্নয়নেই তার কিছু নেতিবাচক প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। তবে সেটি যেন টেকসই উন্নয়ন অভিযাত্রার বিচ্যুতি না ঘটে সেদিকটাকে গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। নদ-নদীর প্রাকৃতিক অবস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে’।
