নিজস্ব প্রতিবেদক ॥কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় গত কয়েক মাসে আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে মাদক চোরাচালান। উপজেলার পাড়ায় পাড়ায় হাত বাড়ালেই মিলছে হেরোইন, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। ৫ আগষ্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃংখলা বাহিনীর কিছুটা নিষ্ক্রয়তার সুযোগে মাদক কারবারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের সময় দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে মাদক চোরাচালানে সক্রিয় ছিল সেই চক্রই সুযোগ বুঝে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা মুল্যে মাদক কেনা বেচা হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

একাধিক সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চিলমারী, রামকৃষ্ণপুর, আদাবাড়িয়া ও প্রাগপুর ইউনিয়নের ৪৬ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ভারত সীমানা। এর মধ্যে ভারতে প্রায় ১৮ কিলোমিটার এলাকা কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও অবশিষ্ট এলাকাগুলো রয়েছে উন্মুক্ত। প্রতিদিন সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিন ফেনসিডিল, হেরোইন ও গাঁজা দেশে ঢুকছে। ভারত থেকে মাদকদ্রব্য নিয়ে এসে সীমান্তের গ্রামগুলোতে জড়ো করা হচ্ছে। পরে সেগুলো উপজেলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আবার সুযোগ বুঝে সেগুলো মাইক্রোবাস, পিকাপভ্যান ভর্তি করে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে। অন্যদিকে সীমান্তের বড় একটি অংশই পদ্মা নদী। ফলে সড়ক পথের পাশাপাশি নদী পথ দিয়েও সহজেই মাদক পাচার করছে চোরাকারবারীরা। উপজেলার বেশ কিছু চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ছাড়াও জনপ্রতিনিধিরাও মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন।
কিছুটা নিরাপদ হওয়ায় মাদক পাচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দরিদ্র মহিলা ও স্কুল পড়ুয়া শিশুদেরকে। মাঝে মধ্যে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা দু’একটি ছোট চালান আটক করলেও বড় বড় চালান চলে আসছে কোন বাধা ছাড়ায়। ভৌগলিক অবস্থার কারনে পুলিশ ও বিজিবি সদস্যরা মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রন করতে হিমশিম খাচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন। ফলে চোরাচালানের মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্নস্থানে অন্তত অর্ধশত মাদক স্পট রয়েছে। বিশেষ করে প্রাগপুর, ধর্মদহ, চিলমারি, পাকুড়িয়া, মুন্সিগঞ্জ, বিলগাথুয়া, ভাগজোত, চল্লিশ পাড়া, জামালপুর, বগমারি. ঠোটারপাড়া, রামকৃষ্ণপুর, মহিষকুন্ডি, মরিচা, ফিলিপনগর, আবেদেরঘাট, বৈরাগিরচর, মথুরাপুর, হোসেনাবাদ, তারাগুনিয়া, কল্যাণপুর, সাদিপুর, বিসিকে, আল্লার দর্গা, রিফায়েতপুর, বড়গাংদিয়া, খলিসাকুন্ডিসহ বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিন অবাধে বিক্রি হচ্ছে নানা ধরনের মাদকদ্রব্য। স্পটগুলোতে রাতের আধারে পাইকারী ও দিনে মাদক খুচরা বিক্রি হয়।
মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দৌলতপুরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চোরাচালান সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের সাথে সখ্যতা রেখেই মাদক সিন্ডিকেট তাদের কারবার চালায়। উপজেলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ মাদকদ্রব্য বিক্রি ও সেবনের সাথে জড়িত বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এ উপজেলায় মাদকদ্রব্যের আগ্রাসন এতটাই ভয়াবহ যে, যখন তখন হাত বাড়লেই নির্বিঘ্নে পাওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা গোপনে ওইসব মাদক ব্যবসায়ীদের গোপনে সহযোগিতা করেন এমন কথা পূর্বে শোনা গেলেও গত আওয়ামীলীগ সরকারের সময় দলীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরাসরি এ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। সরাসরি মাদক কারবারের সাখে যুক্তসহ একাধিক মাদক মামলার আসামীরাও আওয়ামীলীগের দলীয় ক্ষমতায় জনপ্রতিনিধি হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, মাদক ব্যবসার মূল হোতারা কেউই সরাসরি মাদক বহন করেন না। বহন করার জন্য চুক্তিতে লোক নিয়োগ দেয়া আছে। এ কাজে দরিদ্র মহিলা ও শিশুরাও জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে।
সীমান্ত এলাকার স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের স্কুল ব্যাগে করেও পাচার করা হচ্ছে মাদক। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা বেশী নিরাপদ হওয়ায় অধিকাংশ সময় মেয়েদের এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। সীমান্ত এলাকার কয়েকটি গ্রামের অনেক মানুষ মাদক বহন করে জীবিকা নির্বাহ করে। উপজেলার তারাগুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা সাইদুল ইসলাম বলেন, এলাকায় মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে। গত ৫ আগষ্টের পর পুলিশের নিষ্কৃয়তায় মাদক কারবারিরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। উপজেলার বিডিএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইয়াকুব আলী বলেন, মাদক সহজলভ্য হওয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা নেশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। এ কারনে চুরি-ছিনতাই বেড়ে গেছে। দৌলতপুর থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ আওয়াল করিব বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নজরদারি আগের তুলনায় জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের শতভাগ উদ্যোমে কাজ করার ক্ষেত্রে এখনও কিছুটা সীমাবদ্ধ রয়েছে। তারপারও মাদকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।কুষ্টিয়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পারভীন আখতার বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত সার্বক্ষনিক কাজ চলছে। বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চালানো হচ্ছে। মাদক নিয়ন্ত্রনে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও কাজ করছেন।
