তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সংশোধনী খসড়া পাস করতে পারেনি সরকার - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সংশোধনী খসড়া পাস করতে পারেনি সরকার

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৪

খবরওয়ালা ডেস্ক \\ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন তামাক নিয়ন্ত্রন  (এফসিটিসি) সমীক্ষা অনুসারে, টোব্যাকো কোম্পানি ইন্টারভেনশন ইনডেক্স, ২০২৩-এ বাংলাদেশ স্কোর ৭২, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। সবচেয়ে বেশি হস্তক্ষেপ চলমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনকে ঘিরে। তিন বছর পেরিয়ে গেলেও সংশোধনী খসড়া পাস করতে পারেনি সরকার। তামাকজনিত মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। তামাকের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়, পগুত্ববরণ করে আরও প্রায় চার লক্ষ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতি বছর তামাকের কারণে মারা যাবে ১ কোটি মানুষ, যার ৭০ লক্ষই বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের। আসন্ন এই তামাক মহামারির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া প্রতিটি মানুষের নাগরিক অধিকার। রাষ্ট্র তথা সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব এই বিশাল মৃত্যু ও অসুস্থতাজনিত ক্ষয়-ক্ষতি মোকাবিলার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা। বাংলাদেশ সরকার এ বাস্তবতা অনুধাবন করেই ২০০৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণের আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসি’তে স্বাক্ষর এবং পরবর্তীতে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে। কিন্তু কিছু দুর্বলতার কারণে এ আইনটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারায় এটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০৯ সালে। নানা চড়াই উত্তাই পেরিয়ে গত ২৯ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে এ সংক্রান্ত সংশোধনী বিলটি জাতীয় সংসদে পাশ হয়, যা ২ মে গেজেট প্রকাশের মধ্য দিয়ে কার্যকর হয়। তবে তামাক কোম্পানিগুলো আইনের সংশোধনীটি যাতে পাশ না হয় সেজন্য যেভাবে তাদের নানাবিধ কূটকৌশল অব্যাহত রেখেছিল, বর্তমানে আইনটির গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলো (যেমন: ছবিসহ সতর্কবাণী প্রবর্তন) যাতে সঠিকভাবে বাস্তবায়িত না হতে পারে সেজন্যও তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে তামাকপণ্যে করারোপ রোধে কোম্পানিগুলোর কূটকৌশল ও হস্তক্ষেপ থেমে নেই। তার প্রমাণ আমরা চলতি ২০১৩- ১৪ অর্থবছরের বাজেটের আগেও দেখেছি। তামাক কোম্পানি ভালোভাবেই জানে যে একটি কার্যকর করনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কি মাত্রায় তামাক ব্যবসা হ্রাস করতে সক্ষম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য জনস্বাস্থ্যের রক্ষাকবচ এসব তামাক-বিরোধী নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে বাধা প্রদানের জন্য তামাক কোম্পানিগুলো সুকৌশলে জনপ্রতিনিধি, সরকারি আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক এমনকি জনস্বাস্থ্যবিদ এবং চিকিৎসকদেরকে ও ব্যবহার করে থাকে। রাজস্ব প্রাপ্তির সরল হিসাব দেখিয়ে অথবা কর্মসংস্থানের ভুতুড়ে পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে তারা জনপ্রতিনিধিদের সহানুভূতি আদায় করে থাকে। বাংলাদেশ এফসিটিসিতে সর্বপ্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ। তামাকের ভয়াবহতা স্বীকার করেই ২০০৩ সালে প্রণীত তামাক বিরোধী আন্তর্জাতিক চুক্তি ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল এফসিটিসিতে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। তামাক নিয়ন্ত্রণের এই আন্তর্জাতিক চুক্তি একই সঙ্গে তামাকপণ্যের ব্যবহার হ্রাস এবং তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ রুখতে সারা বিশ্বকে একত্রিত করার একটি সার্বজনীন হাতিয়ার। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৭টি দেশ এফসিটিসির পক্ষভুক্ত, যার মাধ্যমে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী এই চুক্তির আওতাভুক্ত। বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালে এফসিটিসি অনুস্বাক্ষর করে। যার ফলে এফসিটিসির সবগুলো ধারা বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক আইনগত বাধ্যবাধকতা সরকারের উপর আরোপিত হয়। এফসিটিসির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণীত হয়, যা সংশোধিত হয় ২০১৩ সালে। তবে তামাক কোম্পানির কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগে সুকৌশলে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। তামাক চাষ থেকে শুরু করে তামাক পণ্যের কর আরোপসহ নানা বিষয়ে তামাক কোম্পানির প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ হস্তক্ষেপ পুরো মাত্রায় অব্যাহত রয়েছে। এমনকি সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সামাজিক দায়বদ্ধতার নামে সুকৌশলে তামাক কোম্পানির প্রচারণাও চলছে ব্যাপকভাবে। তামাক কোম্পানির এ সুকৌশল প্রচারণা ও হস্তক্ষেপ আরো বৃদ্ধি পায় ২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসির আলোকে সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রতিবছর বাজেটে তামাকপণ্যে অধিকহারে কর আরোপে জোরালো দাবি ওঠার পর থেকে। বৃক্ষ (বীজ)  রোপু, বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ, সৌর শক্তি জোগান, দেশ বরেণ্য চিত্রশিল্পীদের দিয়ে চিত্রাঙ্কন এ সমস্ত কিছু আয়োজনের উদ্দেশ্য তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ প্রভাবিত করা,অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনসহ অন্যান্য তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ডে কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় এফসিটিসিতে ৫.৩ ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয় যেখানে, চুক্তিভুক্ত দেশসমূহ তামাক কোম্পানির ব্যবসায়িক ও অন্যান্য স্বার্থ হতে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ও পদক্ষেপসমূহকে সংরক্ষণ করবে বলে উলে­খ করা হয়েছে। কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলো এফসিটিসি সম্পর্কে সরকারের উদাসীনতার সুযোগে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এফসিটিসি যাতে বাস্তবায়ন না হতে পারে সে বিষয়ে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রতিনিয়ত নানারকম অপতৎপরতা অব্যাহত। অন্যদিকে সুপারিশমালা তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপমুক্ত থাকতে সরকারকে অবশ্যই এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ এর নির্দেশনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে হবে। আর্টিক্যাল ৫.৩ এর সকল শর্ত পূরণে নিম্নে বর্ণিত পদক্ষেপসমূহ অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে: ১. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক আর্টিক্যাল ৫.৩ এর প্রতিপালনের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য স্বাস্থ্যখাত ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাথে কাজ করতে হবে ২. তামাক কোম্পানিকে পুরস্কৃত করার যেকোন অনুষ্ঠানে সরকারি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বন্ধ করতে হবে। আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুযায়ী তামাক কোম্পানির সকল সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক (সিএসআর) কার্যক্রম নিষিদ্ধ করতে হবে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দ্বন্দ এড়াতে সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দকে তামাক কোম্পানির পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে ৩. তামাকের চাহিদা হ্রাসকল্পে সরকারকে এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৬ অনুসরণ করে একটি সহজ তামাককর ও মূল্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করতে হবে ৪. ২০২২ সালের মধ্যে তামাক কোম্পানিতে সরকারের শেয়ার/বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হবে ৫. সরকারকে তামাক কোম্পানি এবং এর প্রতিনিধিদের সাথে যোগাযোগের সকল তথ্য এবং নথি প্রকাশ করতে হবে ৬. রপ্তানি শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতিসহ তামাক কোম্পানিকে প্রদত্ত সকল সুবিধা প্রত্যাহার করতে হবে। তামাক চাষে ভর্তুকিকৃত সার ব্যবহার নিষিদ্ধের বিধান কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে ৭. নতুন কোনো বিদেশি তামাক কোম্পানিকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করতে হবে ৮. ২০২১ সালের মধ্যে সরকারকে অবশ্যই তামাক কোম্পানির সাথে যোগাযোগ বা আলোচনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জন্য আচরণবিধি চূড়ান্তকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। তামাক কোম্পানির এই আগ্রাসী হস্তক্ষেপ বন্ধে তামাক নিয়ন্ত্রণ সহায়ক কার্যকর নীতি প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি আরও কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে ১.তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এফসিটিসি এবং এর আর্টিকেল ৫.৩ প্রতিপালনে বাধ্যবাধকতার কথা সরকারকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিতে হবে। এফসিটিসিতে সরকারকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত হয়ে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে ২.তামাক কোম্পানির কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করতে তামাক কোম্পানির নেওয়া অপকৌশলগুলো উন্মোচন করে গণমাধ্যমের সহায়তায় জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। ৩.তামাক কোম্পানির মিথ্যা প্রচারণাগুলো তথ্য-প্রমাণ ভিত্তিক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। আর এসব তথ্য- প্রমাণ তৈরিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মীদের মনোনিবেশ করতে হবে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যম কর্মীরাও এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৪.তামাকশিল্প যে একটি স্বাভাবিক শিল্প নয়, বরং একটি ক্ষতিকর শিল্প, সে বিষয়ে জনসাধারণ ও নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।