কুষ্টিয়া জেলার ঐতিহ্যবাহী জনপদ খোকসা—এর ইতিহাস যেমন প্রাচীন, তেমনি বহুমাত্রিক। একদিকে ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাধনভক্তির কেন্দ্র, অন্যদিকে একসময় গড়ে উঠেছিল এক নিষিদ্ধ সমাজ—একটি পতিতালয়, যা সময়ের স্রোতে বিলীন হলেও ইতিহাসের পৃষ্ঠায় রেখে গেছে এক বিশেষ সামাজিক অধ্যায়।

জনশ্রুতি আছে, খোকসার নামকরণ হয় এক সাধক ‘খোকা শাহ’-এর নামানুসারে। আবার কেউ কেউ বলেন, এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর ‘খোকসা’ নামক বৃক্ষ ছিল—সেখান থেকেই এসেছে নামটি। আজ সেই গাছ প্রায় বিলুপ্ত, তবে কিছু এলাকায় এখনও এর অস্তিত্ব পাওয়া যায়। খোকসা শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই একসময় গড়ে উঠেছিল এমন একটি সমাজ, যেখানে অর্থ, কাম ও সংস্কার—তিনেরই মিশেল ছিল।

ব্রিটিশ আমলের শুরুতেই গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত জানিপুর পুরাতন বাজারের পাশে গড়ে ওঠে খোকসার প্রথম পতিতালয়। তখন খোকসা ছিল ছোট কিন্তু কর্মচঞ্চল নদীবন্দর। গড়াই নদীর বুক চিরে স্টিমার ভিড়ত, ধান-চাল ও কাঠের আড়ৎ বসত, নদীর তীরজুড়ে ছিল জোয়ারের মতো মানুষের ভিড়। বণিক, মাঝি, শ্রমিক, বাবু—সকলের আনাগোনায় তৈরি হয়েছিল এক সামাজিক প্রয়োজন, যার পরিণতিতে জন্ম নেয় খোকসার প্রথম পতিতালয়।
যতদিন নদী ছিল জীবন্ত, ততদিন বেঁচে ছিল সেই পল্লীও। কিন্তু গড়াই নদীর কড়ালগ্রাসে যখন বন্দর বিলীন হতে শুরু করে, তখন ১৯৪০ সালের দিকে পতিতালয়টি স্থানান্তরিত হয় কালীবাড়ি এলাকায়, বর্তমান খোকসা থানার কাছাকাছি।

ব্রিটিশ যুগের বাংলা সমাজে ‘বেশ্যাবৃত্তি’ ছিল একদিকে নিন্দিত, অন্যদিকে গোপনে গ্রহণযোগ্য। এই প্রসঙ্গে কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী তাঁর বই ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে: নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’-তে লিখেছেন—
“বেশ্যাবাজি ছিল বাবুসমাজের সাধারণ ঘটনা। রাজা রামমোহন রায়েরও রক্ষিতা ছিল। সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যাপাড়ায় যেতেন, তা তিনি নিজেই ডায়েরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও নিষিদ্ধ পল্লীতে যেতেন বলে সমসাময়িক সূত্রে উল্লেখ আছে।”
এই বক্তব্য সমাজের এক দ্বৈতচিত্র তুলে ধরে—নৈতিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভোগবাদের রূপ। একদিকে পতিতাদের প্রতি অবজ্ঞা, অন্যদিকে তাদের প্রতি গোপন আকর্ষণ—এই দুইয়ের দ্বন্দ্বই ছিল তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র।
কালীবাড়ি এলাকায় প্রতিষ্ঠিত নতুন পতিতালয়টি ছিল তুলনামূলক ছোট। প্রায় ১৫–২০ কাঠা জমির ওপর ১০–১৫টি ঘর এবং সেখানে বসবাস করতেন ২০–২৫ জন যৌনকর্মী। এই পল্লীর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এক নারী—কুমুদিনী দেবী। তিনি ছিলেন গৃহকর্ত্রী, মধ্যস্থতাকারী ও অভিভাবক—সবকিছুর মিশেল। পতিতাদের নিরাপত্তা ও আয়বণ্টনের সব দায়িত্ব তিনিই সামলাতেন।
সেই সময় পতিতালয়ে আসতেন খোকসা ও আশেপাশের এলাকার প্রভাবশালী বাবুরা, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় গুণীজনেরা। সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ হলেও অর্থনৈতিকভাবে পল্লীটি ছিল স্বনির্ভর—কারণ সেখান থেকেই ঘুরতো বহু শ্রমজীবীর জীবিকার চাকা।
১৯৬০-এর শেষ দিকে, বিশেষ করে ১৯৬৯ সালের পর, সমাজে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা ও নৈতিকতার ঢেউ ওঠে। খোকসার কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর দাবি ওঠে—“এই পল্লী সমাজকলঙ্ক।” পরিকল্পিতভাবে শুরু হয় আন্দোলন, যার ফলেই পতিতালয়টি উচ্ছেদ করা হয়।
তবে ঘটনাটি শুধুই উচ্ছেদ নয়—মানবিকতার এক অনন্য উদাহরণও সৃষ্টি হয়েছিল। খোকসার কয়েকজন মানুষ সেই সময় পতিতাদের স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলে নেন, সমাজে নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ দেন তাদের। ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল মানবিকতা—যা এক অজানা কিন্তু হৃদয়স্পর্শী অধ্যায় খোকসার ইতিহাসে।
উচ্ছেদের পর পতিতা সমাজের কেন্দ্রীয় চরিত্র কুমুদিনী দেবী আশ্রয় নেন খোকসা থানার পাশে, বর্তমান যে জায়গাটি ‘ফিটুর মেস’ নামে পরিচিত।
পরে জনৈক আমজাদ হোসেন নামের ব্যক্তি সেই জমিটি কিনে নেন, আর সেখানেই পতিতালয়টির চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। একটি যুগ, একটি পেশা এবং একটি জীবনধারার অবসান হয়—কিন্তু রেখে যায় অজস্র অনুচ্চারিত গল্প, অগণিত নারীর না বলা কান্না।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে পতিতাবৃত্তি সর্বাধিক প্রাচীন পেশাগুলির একটি। ইতিহাসে এদের বলা হয়েছে নানা নামে—গণিকা, দেহপসারিণী, রক্ষিতা, খানকি, নটি, রূপজীবা, উপপত্নী, কুলটা ইত্যাদি। প্রতিটি যুগে সমাজ এই নারীদের নিন্দা করেছে, আবার তাদের ছাড়া চলেওনি।
বাংলা সমাজে বিশেষত হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও এর একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক আছে। প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘কালিকাপুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ে বলা হয়েছে—
“দুর্গাপূজার সময় দশ রকম মাটি প্রয়োজন হয়, তার মধ্যে একটি মাটি আসে পতিতার দরজার সামনে থেকে। কারণ হিন্দু বিশ্বাসে, পতিতা সমাজের অশুচিতা শোষণ করে সমাজকে পবিত্র রাখে।”
অন্যদিকে ড. লুৎফর রহমান তাঁর ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন—
“এই সমাজে যদি তাদের প্রয়োজন না থাকত, তবে তারা অনেক আগেই হারিয়ে যেত।”
খোকসার পতিতাপল্লীর গল্প কেবল ইতিহাস নয়—এটি সমাজবিজ্ঞানের একটি আয়না। এখানে লুকিয়ে আছে ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা, সামাজিক ভণ্ডামি, আর নারীর বেঁচে থাকার সংগ্রাম। পতিতাদের সমাজ থেকে মুছে দেওয়া হলেও, তাদের বাস্তব অস্তিত্বের প্রয়োজন ছিল অনিবার্য।
তাদের প্রতি সমাজের ঘৃণা যতটা, কৌতূহল তার চেয়েও বেশি। কেউ তাদের অশুচি বলেছে, কেউ আবার ‘মা’ ডেকেছে—এই দ্বৈততা থেকেই বোঝা যায় মানবসভ্যতার অন্তর্নিহিত বৈপরীত্য।
আজ পতিতাবৃত্তি পেশাগতভাবে অবৈধ এবং সামাজিকভাবে নিন্দিত হলেও, ইতিহাস আমাদের শেখায়— অমর্যাদা দূর করার উপায় কখনো পেশাকে মুছে ফেলা নয়; বরং মানবিকতা ফিরিয়ে দেওয়া।
খোকসার পতিতালয় হয়তো এখন শুধুই একটি স্মৃতি, কিন্তু সেই স্মৃতির ভিতর দিয়ে বোঝা যায়—একটি সময়ের সমাজ, নৈতিকতা ও নারীজীবনের নির্মম সত্য কত গভীরে প্রোথিত ছিল। যে সমাজ একসময় তাদের দোষী করেছিল, সেই সমাজই তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজন তৈরি করেছিল।
“বেশ্যাদের ইতিহাস মানে কেবল নিন্দার ইতিহাস নয়, মানবসভ্যতার আত্মসমালোচনার ইতিহাসও।” – এই কথাই হয়তো সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য খোকসার সেই হারিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ পল্লীর জন্য।
