বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়ার খোকসার চাঁদট গ্রামে রাজনৈতিক উপদলীয় কন্দোল ও গোষ্ঠিগত বিরোধের জের ধরে গত কয়েকদিনে কমপক্ষে তিনটি হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। মাঠে জমি চাষ করতে গিয়ে প্রতিপক্ষের হামলায় এক কৃষক আহত হওয়ার পর ভয়ে ওই কৃষকের গোষ্ঠির প্রায় ৩০টি কৃষক পরিবারের লোকেরা মাঠে জমি আবাদ করতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। জানা গেছে, উপজেলার বেতবাড়িয়া ইউনিয়নের চাদট গ্রামের মোল্লা ও খা দের গোষ্টি গত বিরোধ বংশ পরম্পরায়। দুটি গ্রুপ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শের হলেও এখানে উপদলীয় কন্দোল দীর্ঘ দিনের। এর সূত্র ধরে গত বুধবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে বেতবাড়িয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল মোল্লার লোকজন প্রতিপক্ষের কাছ থেকে ৫বিঘা খাস (সরকারী) জমি দখল নেওয়ার ঘোষনা দেয়।
প্রতিরোধ গড়ে তোলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বাবুল আখতারের অনুসারী বর্তমান বিএনপির একাংশের আশ্রয়ে থাকা লাহেরী খা। দুই পক্ষে ভাগ হয়ে শক্তি ও সাহস যোগায় বিএনপির স্থানীয় নেতারা। ঘোষনা দিয়ে দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে “ক্যাজে” করতে মাঠে নামে। সংঘর্ষ চলাকালে পাশের বনগ্রাম এলাকার আমজাদ আলী নামের এক বিএনপির কর্মী ফলাবৃদ্ধ আহত হয়। এ সময় প্রতিপক্ষ হামলা চালিয়ে সিয়াম উদ্দিনের ছেলে দিনমুজুর ইসলামের বসতবাড়ি ভাংচুর করে। এর পর থেকে আওয়ামী লীগ নেতা রেজাউল মোল্লার পক্ষের ৩০ পরিবারের লোকেরা মাঠে জমি চাষ করতে যেতে পারছেন না। শুক্রবার সকালে প্রতিপক্ষের অনুমতি নিয়ে মাঠে পেয়াজের চারা লাগাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন মহন মোল্লা (৪৫)। তাকে মাঠের অন্য শ্রমিকরা উদ্ধার করে খোকসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেছে। প্রথম দিনের ঘটনায় ফলাবিদ্ধ আহত বিএনপি কর্মীর পক্ষে লাহেরী খা বাদি হয়ে খোকসা থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় বনগ্রাম ও চাদট গ্রামের ১৫ জনকে আসামী করা হয়েছে। পুনঃহামলা ভয়ে চাদট গ্রামের অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। যারা বাড়ি আছেন তারও মাঠ ঘাটে যেতে পারছে না। গতকাল শনিবার সকালে চাদট গ্রামটি ছিলো অনেকটাই নিরব। গৃহস্থ্য বাড়ির বসার জায়গা গুলো ছিলো জণশুন্য। সবাই আতঙ্কে।
কেউ কথা বলতে চাচ্ছেন না। গ্রামের শেষ মাথায় বিলের ধারে দিনমুজুর ইসলাম মোল্লার বাড়ি। বাড়ির চারপাশে ঢেউ টিনের বেড়া ছিলো। ঘরেও ছিলো ঢেউটির বেড়া। হামলাকারীরা টিন গুলো কটে টুকরো টুকরো করে রেখে গেছে। প্রতিপক্ষরা পায়খানও হামলা থেকে রেহায় পায়নি। হামলায় ক্ষত বিক্ষত ঘরেই রাত কাটাচ্ছেন দিনমুজুরের পরিবারটি। মোল্লাদের একজন সমর্থককেও মাঠে চাষের জমিতে পাওয়া যায়নি। এমনকী তাদের পুরুষ সমর্থকরাও বাড়িঘর ফেলে আত্মগোপন করেছে। প্রতিপক্ষের হামলায় গৃহহীন দিনমুজুর ইসলামের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম জানান, বুধবার সকালে গ্রামে গন্ডগোল হবে। এই খবর জানার পর তার স্বামী বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ছোট ছোট তিন সন্তান দিয়ে সে শুধু বাড়িতে ছিলো। তার বাড়ির দক্ষিন থেকে মোল্লা’রা আর পশ্চিম থেকে খা’রা কয়েকশ লোক নিয়ে ডাক ভেঙ্গে ঘরে পাশের জমিতে ঝাপিয়ে পরে।
এ সময় এক পক্ষের একজন লোক তার বাড়ির মধ্য দিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর প্রতিপক্ষ তার ঘরে ঢুকে সবকিছু কুপিয়ে টুকরো টুকরো করে রেখে যায়। হামলার আগেই সে সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যায়। ইসলামের মা বৃদ্ধা জহুরা বলেন, হামলার পর পুলিশ এসেছিলো। তারা দেখে গেছে। ছেলেই সংসারের একমাত্র আয়ের মানুষ। জোন-পাট দিয়ে খাই। মামলা করলে আবার যদি হামলা হয় সেই ভয়ে আর থানায় যায়নি। এই বৃদ্ধা হামলাকারীদের সবাইকে চেনেন। অনেক চেষ্টার পর দিনমুজুর ইসলামকে পাওয়া গেলো। তিনি জানান, মারামারির কথা শুনে সকালে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান। কারা তার বাড়ি ভেঙ্গেছেন তা তিনি দেখেন নি। এখন কার বিরুদ্ধে মামলা করবেন। আল্লাহর উপর বিচারের ভাড় ছেড়ে দিয়েছেন। মামলা করলে ছেলে মেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকতে পারবে না। তাই মামলা পথে হাটছেন না। প্রতিপক্ষের হামলায় আহত চিকিৎসাধীন মহন মোল্লা জানান, জমি অন্য লোকের। বিরোধ তাদের। তিনি এ বিবাদের মধ্যে ছিলেন না। তার পরেও এখন বিএনপির নেতাদের কাছে থাকা লাহেরী খা’র কাছ থেকে মাঠে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন।
শুক্রবার সকালে মাঠে যাওয়ার সাথে সাথে ৪/৫ জন বিএনপির ক্যাডার পেছন থেকে তার উপর হামলা করে। শুধু দু’পায়ে লাঠি দিয়ে প্রায় ১০০ টি আঘাত করেছে। হামলায় আহত তিনি এখন আর পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারছেন না। তিনি আরও জানান, বিএনপির ক্যাডাররা দিন রাত গ্রামের মধ্যে মহড়া দিচ্ছে। রেজাউলের লোকদের পেলেই মারবে। এই ভয়ে তাদের অনুসারি প্রায় ৩০/৩৫টি পরিবার মাঠে জমি চাষ করতে যেতে পারছেন না। তিনি এ হামলার ঘটনায় মামলা করবেন না। বিএনপির কর্মী ফলাবৃদ্ধের ঘটনায় দায়ের করা মামলার বাদি লাহেরী খা’র সাথে চাদট বাজারের দেখা করা হয়। তিনি কথা না বলে দ্রত ঘটনা স্থল ত্যাগ করেন। লাহেরী খা’র ভাই টুটুল খান বলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল মোল্লা গত ১৭ বছর ধরে এলাকার মানুষদের উপর অত্যাচার করেছে। এখন আবার অবৈধভাবে লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে জমি দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে। গ্রামবাসী এ ঘটনার প্রতিবাদে রুখে দাড়িয়েছে। রাজনৈতিক মামলায় জেল হাজতে থাকায় রেজাউল মোল্লার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে কামরুল হাসান মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি ও তার ভাইয়ের স্ত্রী হাসি খাতুন জানান ১২ বিঘা জমিতে পিয়াজ লাগাতে পারছিনা ছেলে সন্তান নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি । কখন যেন আবার আমাদের উপর হামলা চালায়।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলাউদ্দিন খান বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল একটি খাস জমি দখলের চেষ্টা করছে। সেখানে স্থানীয় বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। হামলা এখন আর হচ্ছে না। তবে গ্রামের একটি পক্ষের কিছু লোক জমি চাষ করতে যেতে পারছেন না। শনিবারও তাদর সাথে বিএনপি কিছু কর্মীরাও মাঠে জমি চাষ করতে যেতে পারেনি বলে স্বীকার করেন এই নেতা। তিনি বিরোধ নিস্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী কাল রবিবার কৃষকরা যাতে মাঠে যেতে পারে সে বিষয়ে আজ রাতে ব্যবস্থা নেবেন। খোকসা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোতালেব হোসেন বলেন, চাদটে বিএনপি দুই গ্রপের বিরোধ। একটা বড় দল। তারা নিজেরাই সমাধান করে নিতে পারে। তাদের বিরোধে সাধারণ মানুষ ‘সাপারার’ হচ্ছে। জমি-জমার বিরোধ, তারা ইউএনও’র কাছে অথবা আমার কাছে আসতে পারে। তারা তা করছে না। মাঠের কৃষক মহনের উপর হামলা সম্পকে কেউ অভিযোগ করেনি। কেউ হামলার শিকার হলে তার (ওসির) কাছে পাঠাতে বলেন।
