কুষ্টিয়া জেলার নামকরণের ইতিহাস - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

কুষ্টিয়া জেলার নামকরণের ইতিহাস

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: আগস্ট ১৪, ১৯৯৮
Tomb Lalon, Source - Md. Saiful Aziz Shamseer, his file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 license.

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কুষ্টিয়া জেলা ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল। ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ পটভূমি এবং মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য কুষ্টিয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের ধারায় এক বিশেষ পরিচয় লাভ করেছে। কিন্তু কুষ্টিয়া নামের উৎপত্তি বা ব্যুৎপত্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাসবিদ, গবেষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে। এই প্রবন্ধে কুষ্টিয়া নামকরণের সম্ভাব্য উৎস, প্রচলিত মতামত এবং পুরোনো দলিলাদি অনুসারে নামের বিবর্তন বিশ্লেষণ করা হলো।

 

Lalon Tomb, Source - Md. Saiful Aziz Shamseer, This file is licensed under the Creative Commons Attribution-Share Alike 3.0 Unported license.

কুষ্টিয়া নামটি কোথা থেকে এলো—এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর পাওয়া না গেলেও প্রাচীন দলিল, উপনিবেশিক রেকর্ড, লোকজ ব্যাখ্যা ও ভাষাতাত্ত্বিক সূত্র মিলিয়ে কয়েকটি সম্ভাব্য উৎস পাওয়া যায়। নামকরণের ইতিহাস বস্তুনিষ্ঠভাবে বিশ্লেষণ করলে কেবল এক অঞ্চলের নামের উৎপত্তিই নয়, বরং অঞ্চলের ভাষা, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শাসনব্যবস্থা এবং সামাজিক বাস্তবতাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 কুষ্টিয়া জেলার পরিচিতি (SEO–Friendly Background Section)

  • অবস্থান: বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল
  • বিভাগ: খুলনা বিভাগ
  • বিশেষ পরিচিতি:
    • লালন শাহের আখড়া (ছেঁউড়িয়া)
    • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
    • মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্যভিটা
    • ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
    • বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী
  • অর্থনীতি: পাট, চিনি শিল্প, তামাক উৎপাদন
  • ভাষা: সবচেয়ে শুদ্ধ বা প্রমিত বাংলা উচ্চারণের উৎসস্থল হিসেবে বিবেচিত

এই প্রেক্ষাপটে কুষ্টিয়া নামকরণকে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয় যে অঞ্চলটির নাম ইতিহাস ও ভাষার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বহু পর্যায় অতিক্রম করেছে।

কুষ্টিয়া নামকরণের জনপ্রিয়তম ব্যাখ্যা: পাট বা “কুষ্টি/কোষ্টা” থেকে উৎপত্তি

সূত্র: হেমিল্টনের গেজেটিয়ার

উপনিবেশিক আমলের উল্লেখযোগ্য দলিল Hamilton’s Gazetteer–এ কুষ্টিয়া নামকরণের সবচেয়ে সমর্থিত তথ্য পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়:

  • কুষ্টিয়া অঞ্চল একসময় পাট উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত ছিল।
  • স্থানীয় ভাষায় পাটকে বলা হতো “কোষ্টা”, “কুষ্টি” বা “কোশটি”
  • পাটের আধিক্যের কারণে অঞ্চলটি “কুষ্টি” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
  • পরবর্তীকালে নামের শেষে “–আ” বা “–ইয়া” যোগ হয়ে রূপ নেয় “কুষ্টিয়া”
ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

বাংলা ভাষায় নাম গঠনের কয়েকটি সাধারণ নিয়ম রয়েছে—

  • বিশেষ্য শব্দ + আ/ইয়া = স্থাননাম
    যেমন:
  • খুলনা → খুলনিয়া (পুরোনো রূপ),
  • নড়াইল → নড়াইলেয়া,
  • কুষ্টি → কুষ্টিয়া।

এই নিয়ম অনুযায়ী “কুষ্টি → কুষ্টিয়া” ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে ভাষাবৈজ্ঞানিকভাবে গ্রহণযোগ্য।

বিকল্প ব্যাখ্যা: ফারসি শব্দ “কুশতাহ” (Kushtah) থেকে কুষ্টিয়া

ফারসি অর্থ
  • ‘কুশতাহ’ শব্দের অর্থ—
    • ছাইঢাকা ভূমি
    • ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা
    • ভস্মভূমি
ঐতিহাসিক যুক্তি

মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে ফারসি ছিল প্রশাসনিক ও সাহিত্যিক ভাষা।
ধারণা করা হয়—

  • কোনো মহামারী, যুদ্ধ বা অগ্নিকাণ্ডে অঞ্চলটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
  • ফারসি ভাষাভাষীরা এ অঞ্চলকে ‘কুশতাহ’ হিসেবে উল্লেখ করত।
  • সেই শব্দ থেকেই বিবর্তিত হয়ে এসেছে কুষ্টিয়া

এই ব্যাখ্যাটি ভাষাগতভাবে সম্ভাব্য হলেও ঐতিহাসিক প্রমাণ তুলনামূলক দুর্বল।

তৃতীয় ব্যাখ্যা: মুঘল আমলের ‘কুষ্টি বন্দর’ থেকে কুষ্টিয়া

ইতিহাসের প্রেক্ষাপট

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে (১৬২৮–১৬৫৮)
কুষ্টিয়া অঞ্চলে গড়ে ওঠে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর—
“কুষ্টি বন্দর”

নদীপথ বাণিজ্যের গুরুত্ব

পদ্মা, গড়াই ও কুমার নদীর সংযোগস্থলের কারণে এই বন্দর—

  • পণ্য বাণিজ্যের কেন্দ্র
  • কর আদায়ের এলাকা
  • নৌযাত্রার পথনির্দেশক বিন্দু
  • আঞ্চলিক শহর গঠনের ভিত্তি

বন্দরকে ঘিরে ধীরে ধীরে জনবসতি বৃদ্ধি পেয়ে ‘কুষ্টি’ নামটি অঞ্চল–পরিচয়ে পরিণত হয়। পরে এ নাম রূপান্তরিত হয়ে কুষ্টিয়া হয়।

লোককথা ও নৃগোষ্ঠী–ভিত্তিক আরও মত

গোত্র বা সম্প্রদায়নাম থেকে উদ্ভব

অঞ্চলে ‘কোশ্ঠী/কোস্তা’ নামে কোনো নৃগোষ্ঠীর বসতি ছিল—এমন মতও প্রচলিত। তবে এ তথ্যের পক্ষে প্রাচীন দলিল দুর্লভ।

প্রাচীন দুর্গ–নামের সম্ভাবনা

কিছু গবেষক কুষ্টিয়ার নামকে ‘কোস্টগড়’ বা ‘কোষ্ঠগড়’ নামক পুরনো দুর্গ বা বাজারের সঙ্গে যুক্ত করেন। কিন্তু এ ব্যাখ্যারও শক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই।

কোন ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য? (Conclusion for SEO)

যদিও কুষ্টিয়া নামের বিষয়ে চূড়ান্ত দলিল নেই, তবু ঐতিহাসিক প্রমাণ, ভাষার নিয়ম, এবং উপনিবেশ আমলের নথির ভিত্তিতে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য মত হলো—

➡ পাটের স্থানীয় নাম “কুষ্টি” থেকেই “কুষ্টিয়া” নামের উৎপত্তি

ফারসি ও মুঘল–ভিত্তিক ব্যাখ্যাগুলো সাংস্কৃতিক প্রভাবের সাক্ষ্য বহন করে, তবে ঐতিহাসিকভাবে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।

কুষ্টিয়া—এক নামের পিছনে শিল্প, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের আত্মা

আজকের কুষ্টিয়া শুধু একটি জেলা নয়—

  • লালন সাঁইয়ের দর্শন,
  • রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসম্ভার,
  • বাউল–ফকিরদের সাধনা,
  • মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি,
  • এবং প্রমিত বাংলার ভাষিক ঐতিহ্য

সব মিলিয়ে কুষ্টিয়া বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মার এক অনন্য প্রতীক। নামটি যেখান থেকেই আসুক না কেন, “কুষ্টিয়া” এখন প্রতিষ্ঠিত— সংস্কৃতি, মানবধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস ও মুক্তচিন্তার এক চিরস্থায়ী অধ্যায়ের প্রতীক হিসেবে।