কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয়

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: আগস্ট ১৪, ১৯৯৬
কুষ্টিয়া সার্কিট হাউস

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত কুষ্টিয়া জেলা শুধু একটি প্রশাসনিক অঞ্চল নয়—এটি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সৃজনশীলতা ও ইতিহাসের এক অপূর্ব সম্মিলনস্থল। খুলনা বিভাগের অন্তর্গত এই জেলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পৌরসভা এবং একাদশ বৃহত্তম নগরী হিসেবে পরিচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর আজকের কুষ্টিয়ার অংশ—যা এই জেলার রাজনৈতিক মর্যাদা ও ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আলাদা উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছে।

কুষ্টিয়া বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এ জেলাতেই বিশ্রাম নিচ্ছেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ—যাঁর মানবধর্মের দর্শন ও জীবনদৃষ্টি আজও বাঙালির মনের সুরে ধ্বনিত হয়। এখানকার শিলাইদহে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি, যেখানে তিনি বাংলার মাটি, মানুষ ও নদীঘেরা প্রকৃতির মাঝে থেকে রচনা করেছেন সাহিত্য-সঙ্গীতের বহু অমর সৃষ্টি। কুষ্টিয়ায়ই রয়েছে উপন্যাসকার মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা—“বিষাদ সিন্ধু”-র স্রষ্টার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত সেই পরিবেশ আজও সাহিত্যপ্রেমীদের টানে।

 

কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয়

কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয়

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক উত্থান

স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী চিন্তা, গবেষণা ও আধুনিক উচ্চশিক্ষার অন্যতম কেন্দ্র ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া জেলাতেই অবস্থিত। এটি দেশের একমাত্র সরকারি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি শিল্প-সংস্কৃতির চর্চায় কুষ্টিয়ার অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পকলা একাডেমি এখানেই প্রতিষ্ঠিত। অজস্র নাট্যচক্র, সংগীত বিদ্যালয়, সাহিত্য-চর্চা কেন্দ্র এবং বাউল আখড়া কুষ্টিয়াকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

ভাষাগত দিক থেকেও কুষ্টিয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভাষাবিদদের মতে, এ অঞ্চলের কথ্য ভাষাই বাংলার সবচেয়ে শুদ্ধ উচ্চারণরীতি বহন করে—যা পরবর্তীকালে মানক বা প্রমিত বাংলা উচ্চারণের ভিত্তি গঠনে ভূমিকা রেখেছে।

 

 

কুষ্টিয়ার প্রশাসনিক ও ঐতিহাসিক বিবর্তন

কুষ্টিয়ার প্রশাসনিক পরিচয়ের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
১৭২৫ সালে কুষ্টিয়া নাটোর জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং কান্ডানগর পরগনার রাজশাহী ফৌজদারির সিভিল প্রশাসনের অধীন হিসেবে পরিচিতি পায়।
পরবর্তীতে ১৭৭৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কুষ্টিয়াকে যশোর জেলার অন্তর্ভুক্ত করে।

এরপর ইতিহাস আবার মোড় নেয়—
১৮২৮ সালে কুষ্টিয়া পাবনা জেলার আওতায় চলে আসে।
১৮৬১ সালের নীল বিদ্রোহ কুষ্টিয়ার প্রশাসনে বড় পরিবর্তন আনে; বিদ্রোহ দমনের সুবিধার্থে কুষ্টিয়াকে মহকুমা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৮৭১ সালে কুষ্টিয়া মহকুমা কুমারখালী ও খোকসা থানা নিয়ে নদীয়া জেলার অধীনে যায়।
ব্রিটিশ ভারতের শেষ সময়ে কুষ্টিয়া ছিল নদীয়া জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ মহকুমা।

১৯৪৭ সালের দেশভাগের মধ্য দিয়ে কুষ্টিয়া জেলা হিসেবে অভ্যুদয় লাভ করে।
তখন জেলার তিনটি মহকুমা ছিল—
১) কুষ্টিয়া
২) চুয়াডাঙ্গা
৩) মেহেরপুর

অবশেষে ১৯৮৪ সালে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর আলাদা জেলা ঘোষিত হলে, কুষ্টিয়া মহকুমার ছয়টি থানাকে নিয়ে বর্তমান কুষ্টিয়া জেলা পূর্ণতা পায়।

বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো

আজকের কুষ্টিয়া জেলা নিম্নরূপভাবে বিভক্ত—

  • ৬টি উপজেলা
  • ৭টি থানা
  • ৫টি পৌরসভা
  • ৫৭টি ওয়ার্ড
  • ৭০টি মহল্লা
  • ৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ
  • ৭১০টি মৌজা
  • ৯৭৮টি গ্রাম

এ বিশাল প্রশাসনিক কাঠামো কুষ্টিয়ার জনবহুলতা ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নকেই প্রতিফলিত করে।

কুষ্টিয়া শুধু একটি ভূগোল নয়—এটি ইতিহাস, সাহিত্য, শিক্ষা, শিল্প, মানবধর্ম, বাউলসাধনা, রবীন্দ্রসংগীত এবং রাজনৈতিক স্মৃতির সম্মিলিত ঐতিহ্য। বাঙালির মুক্তিচেতনা, সংস্কৃতি ও মানবতার সুর কুষ্টিয়ার মাটি, নদী ও মানুষের জীবনধারায় মিশে রয়েছে আজও।

ইতিহাসের পথ ধরে কুষ্টিয়ার অভ্যুদয় শুধু প্রশাসনিক বিবর্তন নয়—এটি এক সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক উত্থানের দীর্ঘ যাত্রা।