বিশেষ প্রতিনিধি ॥ দেশের অন্যতম বৃহৎ চালের মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগরে ৫ আগস্টের পর ব্যাপক চাঁদাবাজির কবলে পড়েছেন মিল মালিকরা। এতে আওয়ামী লীগের সমর্থক মিল মালিকরা পড়েছেন বিপদে। সাধারণ মিলারদেরও হয়রানি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর এখানকার পাঁচ শতাধিক চালকল থেকে ৫০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়েছে। সদর উপজেলা ও বটতৈল ইউনিয়ন বিএনপি এবং সহযোগী সংগঠনের চার নেতা এসব কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা জানান, স্থানীয় বিএনপির দুটি গ্রুপ থাকায় হয়রানির মাত্রা আরও বেড়েছে। এক গ্রুপকে চাঁদা দিলে এবং অন্য গ্রুপকে না দিলে মামলায় আসামি করা হচ্ছে। এতে মোকামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তারা কারও নাম জানাতে চাননি। এরই মধ্যে তিনটি মামলায় খাজানগরের ১২ মিল মালিককে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে বড় মিলের মালিক রয়েছেন পাঁচজন। মোকামে এমন বড় মিল রয়েছে ৪৮টি।
একাধিক মামলাতেও আসামি হয়েছেন কয়েকজন। মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে থাকা খাজানগরের একজন শীর্ষ মিল মালিক বলেন, তিনি কোনো দলের রাজনীতি করতেন না। তাঁর কোনো পদপদবি নেই। আওয়ামী লীগ আমলে দলটির কয়েকজন নেতার সঙ্গে ওঠাবসা করতেন। এ ছাড়া আওয়ামী সমর্থিত চালকল মালিক সমিতির কমিটিতে পদে ছিলেন। এসব কারণে তাঁর নামে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে হতাহতের ঘটনায় ৬ সেপ্টেম্বর রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় দুটি মামলা হয়। এর একটি মামলার বাদী কুষ্টিয়া সদর উপজেলার দহকুলা ইউনিয়নের নওয়াপাড়া গ্রামের আশরাফুল ইসলাম।
এ মামলায় ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৮-১০ জনকে আসামি করা হয়। আন্দোলনের সময় আশরাফুল গুলিতে আহত হয়েছিলেন। অন্য মামলাটি করেছেন কুষ্টিয়া শহরের চর থানাপাড়া এলাকার কোরবান আলীর স্ত্রী রুনা খাতুন। এতে তিনি আসামি হিসেবে ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করেন এবং অজ্ঞাত আসামি করেন ১০-১৫ জনকে। রুনা খাতুন ছেলেকে খুঁজতে গিয়ে গুলিতে আহত হয়েছিলেন। তাঁর ছেলে পানির মিস্ত্রি রুহুল আমিনও ৫ আগস্ট আহত হয়েছিলেন। দুটি মামলাতেই মাহবুবউল-আলম হানিফসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি করা হয়েছে।
এ দুটি মামলায় বটতৈল ইউনিয়নের খাজানগর গ্রামের ১৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন মিল মালিক ও ব্যবসায়ী। এর মধ্যে রয়েছেন দেশ এগ্রো লিমিটেডের আবদুল খালেক, দাদা রাইস মিলের মালিক হাজি আরশাদ আলী, মেসার্স সুবর্ণা এগ্রো ফুডের মালিক জিন্নাহ আলম, ফ্রেশ এগ্রো লিমিটেডের মালিক ওমর ফারুক। এ ছাড়া তৃতীয় একটি মামলায় গুরুর দান রাইস মিলের মালিক সুজনকে আসামি করা হয়েছে। দেশের শীর্ষ এসব মিল মালিক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর হানিফের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতেন। এর মধ্যে ওমর ফারুক সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে আছেন।
বাকিরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত চালকল মালিক সমিতির নেতা হলেও দলের কোনো পদে নেই। চালকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকজন চালকল মালিকের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে। একই সঙ্গে গণহারে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, টার্গেট করে খাজানগর গ্রামের ব্যবসায়ীদের আসামি করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সবার কাছেই কমবেশি নগদ টাকা থাকে। তাই মামলার আসামি হওয়ার ভয়ে টাকা দিয়ে দিচ্ছেন তারা। সবাইকে চাঁদা দিতে হচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। দাদা রাইস মিলের মালিক হাজি আরশাদ আলী বলেন, ‘শুধু হয়রানি করার জন্য আমাকে আসামি করা হয়েছে। আমরা ব্যবসা করি। যারা সরকার ও ক্ষমতায় থাকে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা লাগে।
এ কারণে কেউ যদি মিথ্যা মামলা করে, তার জন্য কী করার আছে? তবে এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ অটো চালকল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক ও দেশ এগ্রো ফুডের মালিক এম এ খালেক বলেন, সরাসরি দলের কোনো পদে না থেকেও আমাদের নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। চালকল মালিকরা এ নিয়ে শঙ্কিত। যদি হয়রানি করা হয়, তাহলে আমাদের মিল বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় নেই।
তিনি বলেন, অনেকেই চাঁদা নিচ্ছেন, আবার মামলা সাজিয়ে কাগজ বাড়ি বাড়ি নিয়ে গিয়ে মামলায় নাম দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়া হচ্ছে। মামলা হওয়ার ফাইনাল চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার কথা বলেও টাকা দাবি করা হচ্ছে। মামলার ব্যাপারে জানতে রুনা খাতুনের মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিলে রিসিভ করেন তাঁর ছেলে রুহুল আমিন। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় আমার গায়ে ছররা গুলি লাগে। আমার মা আমাকে খুঁজতে এলে তাঁরও গুলি লাগে। আমরা দু’জনই আহত হয়েছি। কারা গুলি করেছে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমে টিয়ার গ্যাসের শেল ছোড়া হয়। পরে গুলি করা হয়।
ধোঁয়ার কারণে কাউকে দেখতে পাইনি। পার্টি অফিস (বিএনপি) থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আরেক মামলার বাদী আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি বিএনপির রাজনীতি করি। আন্দোলনের দিন পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের লোকজনও ছিলেন। তাদের অনেককে আমি চিনি। চালকল মালিকদের আসামি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সবাই কি আর দল করে? অনেকে ডোনার থাকেন, সহযোগিতাও করেন।
চাঁদাবাজি ও ঢালাও আসামি করার বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন বলেন, দলের নাম ভাঙিয়ে কোনো অপকর্ম করার সুযোগ নেই। নিরীহ কোনো মানুষকে আসামি করার বিপক্ষে আমাদের দল। তবে দোষীদের নামে মামলা হলে সেটি আলাদা কথা। কুষ্টিয়া মডেল থানার ওসি মাহফুজুল হক চৌধুরী বলেন, থানায় মামলা হয়েছে বেশ কয়েকটি। পুলিশ মামলার পর তদন্ত করছে। আর খাজানগরে চালকল মালিকদের পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি বা অন্য কোনো ঘটনায় কেউ কোনো অভিযোগ দেননি। দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
