কুষ্টিয়ায় ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

কুষ্টিয়ায় ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা প্রকল্পের টাকা ভাগাভাগির অভিযোগ

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: অক্টোবর ৫, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ২০১৬ সালে ২০০ কোটি টাকা ব্যায়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি রক্ষা বাঁধ নির্মানের বছর না যেতেই নদীতে ধ্বসে পড়ে বাঁধের কয়েক’শ মিটার। দুটি স্থানে ভাঙ্গন দেখা দেয় বাঁধের। এলাকাবাসী তখন অভিযোগ করেন, অনিয়ম, দুর্নীতি আর সিডিউল অনুযায়ী কাজ না করায় ভাঙ্গন দেখা দেয় বাঁধে। বাঁধ নির্মানের কাজটি বাস্তবায়ন করেছিলেন বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্ট্রার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক বসির উদ্দিন। যিনি আওয়ামী লীগ আমলে সারা দেশে নদী রক্ষা প্রকল্পের বড় বড় কাজ করছেন। তার বেশির ভাগ কাজেই গলদ রয়েছে। এবার সেই প্রতিষ্ঠানকে আবারো প্রায় ২০০ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়ার মিরপুরে পদ্মা নদীতে বাঁধ নির্মানের। হানিফের মাধ্যমে তিনি এ কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া অন্য আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাজও বসির তার নিজের কজ্বায় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এদিকে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বসির উদ্দিন কিছুটা চাপে পড়েছেন। বিএনপির কয়েকজন নেতা এ প্রকল্প থেকে নতুন করে কমিশন বাড়িয়ে নেওয়া চেষ্টা করছেন।

তারা কয়েকজন ঠিকাদারকে ফোন দিয়ে কমিশনও দাবি করেছেন। ঠিকাদার ও বিএনপি সুত্র জানায়, বসির তার নিজ এলাকা কুষ্টিয়ার তিনজন নেতাকে নতুন করে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে এক বিএনপিকে তিনি ৩০ লাখ টাকায় একটি গাড়িও উপহার দিয়েছেন। বাকি দুই নেতাও দুটি হ্যারিয়ার উপহার চেয়েছে। তবে সেই গাড়ি দুটিও হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীন বাঁধ নির্মানসহ নদী শাসনের যত কাজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্ট্রার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং করেছে তার বেশির ভাগেই ছিল গলদ। কোন কাজই দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

বছর না ঘুরতেই তাদের নির্মাণ করার বেশির ভাগ বাঁধ ভেঙ্গে নদীতে চলে গেছে। হানিফের ঢাকার কাওরান বাজারের অফিসে বসে এপ্রিল মাসে বসে হয় কাজ ভাগাভাগি। ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার কাজের মধ্যে হানিফ তার নিজের ভাগে রাখেন প্রায় ৫০০ কোটি টাকার কাজ। এখান থেকে দুটি প্যাকেজের কাজ তিনি বসিরের প্রতিষ্ঠানকে দেন। কাজ ভাগাভাগিতে জড়িত এমন সুত্র জানায়, হানিফ ৫৩০ কোটি টাকার কাজ নিজের কাছে রেখে দেন।

পরে তার ঘনিষ্ঠ স্যাডো পার্টনার বসিরের প্রতিষ্ঠান ওয়েষ্ট্রার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাছ থেকে মোটা কমিশন নিয়ে বিক্রি করে দেন দুটি প্যাকেজের কাজ। প্রতিটি প্যাকেজের ব্যায় ধরা হয়েছে প্রায় শতকোটি টাকার কাছে। সুত্র জানায়, এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডর মেথর্ড) পদ্ধতিতে হওয়ার কথা। মুলত ৫% কমদরে কাজটি বাস্তবায়নের নিয়ম। এখানে সরকার নির্ধারিত রেট জানার কোন সুযোগ না থাকলেও হানিফ ও বসির প্রভাব বিস্তার করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের হাত করে রেট জেনে নেন। এ কারনে বাইরের কোন ঠিকাদার কাজে অংশ নিতে পারেননি। কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানাগেছে, পদীর নদীর ভাঙ্গন হতে কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলাধীন তালিবাড়িয়া এবং কুমারখালী উপজেলাধীন শিলাইদহ ইউনিয়নের কোমরকান্দি এলাকা রক্ষা শীর্ষক প্রকল্পের টেন্ডার গত এপ্রিল মাসে ওপেন হয়। প্রকল্পে ব্যায় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। পদ্মার নদীর ১০.৫৩ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঁধ নির্মাণ হবে এ প্রকল্পের আওতায়।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা ও কাজ পেয়েছেন এমন একজন ঠিকাদার বলেন, ‘কাজটির বড় অংশ ছিল হানিফের মিরপুর উপজেলায়। হানিফের বাড়ি ভেড়ামারায় আর বসির তার পাশের উপজেলা মিরপুরের সন্তান। বসির এক সময় বিএনপি নেতাদের ম্যানেজ করে বড় বড় কাজ বাগিয়ে নিলেও গত ১৫ বছরে হানিফের হাত ধরে তার উত্থান। কুষ্টিয়া ছাড়াও সারা দেশে পানি উন্নয়ন বোর্ডে সকল কাজ তিনি প্রায় একাই করেছেন। তবে তার কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। বাঁধ নির্মানের পর কোন কাজই তেমন টেকসই হয়নি। বিশেষ করে রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি রক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ছিল।

তারপরও তিনি এলাকার নেতাদের ম্যানেজ করে পার পেয়ে যান। শিলাইদহ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আনারুল মিয়া বলেন, বসির যখন কাজ করতে আসেন তখন স্থানীয় এমপি রউফসহ অন্যদের সাথে নিয়ে এলাকায় আসেন। নেতাদের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করছিলেন বলে আমরা শুনেছি। নির্মান কাজ শেষ না হতেই বাঁধে ধ্বস নামে ও বসে যায়। এটা নিয়ে এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছিল।’ পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্র জানিয়েছে, প্রথম দিকে কাজটির ব্যায় বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক ধরে একনেকে পাশ করার সিদ্ধান্ত হয়। পরে বসির মাহবুবউল আলম হানিফকে দিয়ে তদবির করে ব্যায় বাড়িয়ে নেন। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতা বাড়ে।

মন্ত্রনালয় অর্থ বরাদ্দের পর ঢাকায় হানিফের কাওরান বাজারে বিটিএমসি ভবনের অফিসে কয়েকদফা মিটিং হয় ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কয়েকজন প্রকৌশলীর। এ কাজে ভাগ বসাতে তৎকালিন পানি মন্ত্রীর ভাগ্নেসহ কয়েকজন চেষ্টা করেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, বসিরের প্রতিষ্ঠান দুটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে।  তবে বসির তার প্যাকেজের কাজ এখনো শুরু করেনি, চুক্তি করেছেন মাত্র।  হানিফের সাথে বসিরের অলিখিত পার্টনারশীপ আছে বলেও ঠিকাদাররা জানান। জানাগেছে, ৮টি প্রতিষ্ঠান ১ হাজার ৪৭২ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। জয়েন্ট ভ্যানচার (জেভি থাকায়) মুলত ১৬টি প্রতিষ্ঠান যুক্ত রয়েছে কাজ বাস্তবায়নের।

  ৩৩টি প্যাকেজের মধ্যে ৪টি কুমারখালীর শিলাইদহে। সেখানে ২৭০ কোটি টাকার মত কাজ রয়েছে। আর বাকি টাকা ব্যায় হবে মিরপুরে। কাজটি ২০০৪ সালের জুনে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বররে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। সুত্র জানায, কাজটি ৫ শতাংশ কম দরে করার জন্য প্রাক্কলন ধরা হয়। তবে পরে ভাগাভাগি হওয়ায় সমদরে কাজটি হওয়ায় সরকারের প্রায় ৮০ কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করায় কারনে প্রতিযোগিতামুলক না হওয়ায় এই ৮০ কোটি টাকা হানিফ ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিয়ে পকেটে ভরেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সুত্র জানিয়েছে, কাজ ভাগাভাগিতে ছিলেন বসির ও হানিফ।

এ সময় সেখানে কয়েকজন প্রকৌশলী ছিলেন। তারাও তাদের কমিশন বুঝে নেন। কাজ শুরুর আগেই সব পক্ষ কমিশন বুঝে নেন এ কাজ থেকে। পতিত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীও কমিশন নিয়েছে এ প্রকল্প থেকে। এমনকি কাজ নিয়ে তারা অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।’ কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, ‘বসির দুটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে। চুক্তি করেনি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে কাজও শুরু করেছে। যে কেউ চুক্তি না করে তাহলে সয়ংক্রিয় ভাবে তার কাজ বাতিল হয়ে যাবে। দরপত্র পক্রিয়া সঠিক ভাবে হয়েছে বলেও জানান তিনি। এদিকে ওয়েষ্ট্রার্ণ ইঞ্জিয়ারিং এর কর্ণধার বসির উদ্দিন বলেন,‘ তিনি নিয়ম মেনে কাজ পেয়েছেন। কাউকে কোন কমিশন দিয়ে কাজ নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তার কাজের মান নিয়েও কোন প্রশ্ন নেই বলে দাবি করেন।