নিজ সংবাদ ॥ শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য প্রমত্তা পদ্মানদী। আবার কুষ্টিয়া শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পদ্মার প্রধান শাখা গড়াই নদ পরিণত হয়েছে মরা খালে। অপরদিকে, শুষ্ক মৌসুমের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় কুষ্টিয়া জেলা ও এর আশপাশের এলাকার নলকূপগুলো হয়ে পড়েছে বিকল। পানি উঠছে না অনেক গভীর নলকূপেও। এমনকি শহরাঞ্চলের কোনো পানির মোটরেও উঠছে না পানি। পানি না ওঠায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে কয়েক হাজার নলকূপ। তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা জনজীবনে। এতে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে কুষ্টিয়ার জনজীবন। কিছু নলকূপে পানি উঠলেও তা খুবই কম, এক কলস পানি ভরতে সময় লাগছে ১৫/২০ মিনিট। শত চাপে এক ঘড়া পানিও মিলছে না। তাই সুপেয় পানির জন্য শহরজুড়ে চলছে হাহাকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূগর্ভস্থ পানির যত্রতত্র ব্যবহারের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কুষ্টিয়ার মাঝে প্রবাহিত অপরূপ প্রমত্ত পদ্মা কিংবা গড়াই নদী এখন প্রায় মৃত অবস্থা। প্রমত্তা গড়াই এখন পরিণত হয়েছে ছোট খালে। এর প্রভাবে কুষ্টিয়া পৌর এলাকাসহ এর আশেপাশের প্রায় লাখের অধিক নলকূপে উঠছে না পানি। এমনকি পানির স্তর নেমে যাওয়ায় নদীর এমন করুণ পরিণতির কারণে এখানকার মানুষের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রাকৃতিক এই সমস্যা সমাধানে তাদের কিছুই করার নেই। তবে বৃষ্টি হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে। শুধু নদী তীরবর্তী এলাকাই নয়, পুকুর কিংবা খাল বিল কোথাও পানি নেই। টিউবওয়েলেও পানি উঠছে না। শত চাপে এক ঘড়া পানিও মিলছে না। তবে বিকল্প হিসেবে যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারা সাব মার্সেবল পাম্প বসিয়ে সুপেয় পানির চাহিদা মেটাচ্ছেন। কুষ্টিয়া পৌরসভার দেওয়া তথ্যমতে, পৌর এলাকার ২১টি ওয়ার্ডে হোল্ডিং সংখ্যা ৩৭ হাজার, যার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই নিজস্ব নলকূপ আছে। এছাড়া পৌরসভার পক্ষ থেকে বিভিন্ন এলাকায় দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫ হাজারের উপরে নলকূপ। পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণে এসব এলাকার যেগুলো নলকূপ কাজ করছে সেগুলোতে পানি উঠছে অতি সামান্য। শুধু পৌর এলাকায় নয়, শহর সংলগ্ন হরিপুর ইউনিয়ন, কয়া, শিলাইদহ ইউনিয়নসহ আরো অনেক এলাকায় চলছে পানির জন্য হাহাকার। তবে গড়াই নদীর তীরবর্তী বসবাস করা মানুষের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। পানির সংকট এতটাই প্রকট যে খাবার পানির পাশাপাশি গোসল এবং গবাদি পশুর জন্য পানির ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাওয়া লাগছে। পানির জন্য নদীর চরের প্রায় দেড় দুই কিলোমিটার হেঁটে যেতে হচ্ছে তাদের। এমন সংকটে এর আগে কখনো পড়েননি তারা। আছিয়া খাতুন নামের হরিপুর এলাকার এক গৃহবধূ বলেন, পানির খুবই সমস্যা, বড় সমস্যা হলো টিউবওয়েলে পানি থাকে না। খাওয়ার পানির জন্য বেশি সমস্যা। অনেক দূর থেকে পানি নিয়ে আসা লাগে। আর অন্যান্য কাজের পানি এই নদী থেকে নেয়া লাগে। নদী থেকে নিয়ে আমরা অন্যান্য চাহিদা মেটাই। এটাই আমাদের সমস্যা, আর কিছুদিন হলো এই সমস্যা অনেক ভোগান্তি দিচ্ছে। আনোয়ারা বেগম নামের শহরের থানাপাড়া এলাকার আরেক গৃহবধূ বলেন, আমাদের নলকূপে পানি উঠছে না। গোসলের জন্য আমাদের নদীর মধ্যে বালুর উপর দিয়ে প্রায় এক মাইল হেঁটে যেতে হয়।

যে গরম খুবই সমস্যা হচ্ছে। আর খাবার পানি আনতে হয় পাশের একবাড়ি থেকে। সেখানে সাবমার্সেবল কল বসানো। কিন্তু সব সময় গেলে পানি দেয় না। তাদের ইচ্ছে মতো সময়ে দেয়, কি আর করার। আমরা গরিব মানুষ, কোনো রকম তাদের অনুরোধ করে এক কলস পানি নিয়ে এসে সারাদিন খাই। এদিকে, পানির অভাবে বোরো আবাদও ব্যাহত হচ্ছে। কোনো আবাদেই সুফল মিলছে না। তাই কৃষকদেরও দূরাবস্থা। খাল বিল কিংবা নদী নালায় পানি না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। এরই মধ্যে বোরো আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। অন্যান্য ফসলও আবাদ করতে পারছেন না পানি ছাড়া। পানির অভাবে কোনো ফসলই উৎপাদন করতে পারছেন না। বিশেষ করে বোরো ধান রোপণ করেও পানির অভাবে তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। জিকে ক্যানেলে পানি নেই। বাড়তি খরচ করে শ্যালোইঞ্জিন দিয়ে ধানক্ষেতে পানি দিব তাতেও পানি উঠছে না। ধানের আবাদ না হলে আগামী দিনগুলো খুব কষ্টে কাটবে বলেও জানান তিনি। মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের সাইদার আলী নামের এক কৃষক বলেন, ভাই কী বলবো, খুব দুর্যোগ চলছে। গ্রামের ৯৫ ভাগ কলে পানি উঠছে না। মাঠে মাটির ১০ ফিট নিচে বোরিং পুঁতলেও পানি উঠছে না। মাঠের কোনো ক্যানালে খাল বিলে পানি নেই। ধান ফসল সব শুকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এতে করে যেখানে ৩০ মণ ভুট্টা পাওয়ার কথা সেখানে ১০ মণ হবে না। যেখানে ধান ১০ মণ হওয়ার কথা সেখানে ধান ৫ মণ হবে। আমরা কৃষক কিভাবে বাঁচবো। কোনো ক্যানালে পানি থাকলেও কৃষক একটু তা দিয়ে আবাদ করতে পারতো। মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে বোরো ধানের ফুল বিবর্ণ রং ধারণ করছে। এভাবে চললে ধানের চিটা দেখা দেবে। এ থেকে রক্ষা পেতে হলে ধানের ক্ষেতে পানি ধরে রাখতে হবে। কিন্তু জিকের খালসহ কোনো জলাধারেই পানি না থাকায় ধানসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে পানি দিতে পারছে না কৃষক। যারা বিকল্প কোনো পন্থায় পানি দিতে পারছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে তাদের পানিও একদিনের বেশি মাঠে থাকছে না। শুকিয়ে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। এতে চলতি মৌসুমে বোরো আবাদে ফলন বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন এই কৃষি কর্মকর্তা। গড়াই নদীর উপর অবস্থিত সৈয়দ মাছ উদ রুমী সেতু এবং গড়াই ব্রিজের নিচে ড্রেজিং করার ফলে কিছুটা পানি প্রবাহ থাকলেও অধিকাংশ পিলার ধূ-ধূ বালির উপর রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই গড়াই নদীর অনেক স্থান দিয়ে হেঁটে পার হচ্ছে। পানি শূন্য এই গড়াই নদী শুধুই এখন স্মৃতি। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবেই এই গড়াই নদীর করুণ দশা বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন। কুষ্টিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ বলছে, নদীগুলোর নাব্যতা না থাকার পাশাপাশি পানির স্তর বিগত বছরগুলোর তুলনায় ২৫ থেকে ৩০ ফিট নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত নলকূপে পানি উঠছে না। পানি সরবরাহের বিকল্প ব্যবস্থা সক্রিয় না থাকায় বিপাকে পড়েছে জনজীবন। এমনকি পৌরসভার পক্ষ থেকে যে সাপ্লাই পানির ব্যাবস্থা করা আছে তার উৎপাদনও অনেক কম। এটি একটি প্রাকৃতিক সমস্যা। বৃষ্টি শুরু হলেই এই সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ড. রেজওয়ানুজ্জামান বলেন, তীব্র পানি সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ খাল-বিল নদী নালায় পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির যত্রতত্র ব্যবহার। শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীর পানি শুকিয়ে যায়, সেক্ষেত্রে যেসব নলকূপের লেয়ার কম দেওয়া সেসব নলকূপে পানি না ওঠারই কথা বলে জানান তিনি।
