রঞ্জুউর রহমান ॥ ডাক্তারদের মূলমন্ত্র মানুষের সেবা প্রদান হলেও সেবার নামে বেপরোয়াভাবে মানুষের টাকা কেড়ে নিচ্ছেন। বেশির ভাগ জ্যেষ্ঠ ডাক্তারদের ভিজিট এখন এক হাজার টাকা। তাঁরা প্রতিদিন রোগী দেখেন ৪০-৫০ জন করে। কেউ কেউ অবশ্য আরো বেশি রোগী দেখেন, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁদের চেম্বারের বাইরে সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকে রোগীরা। ফলে দিনে কেবল রোগীর ফি থেকেই তাঁদের আয় হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে ল্যাবরেটরি-প্যাথলজি-ওষুধ কম্পানি ও হাসপাতালসহ নানা উৎস থেকে আসে আরো কয়েক হাজার টাকা। টাকার পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক সময় তাদের নীতি-নৈতিকতার কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
চিকিৎসকদের এই প্রবণতা বন্ধ করা না গেলে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় সেবাব্রত বা মানবিকতা বলে কিছুই থাকবে না। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিরা জনগণের টাকায় পরিচালিত হয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারিরা জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কর্মযজ্ঞ মাথায় নিয়েই চাকরিতে যোগদান করার পরপরই দায়িত্বজ্ঞানকে ভুলে প্রচলিত ধারায় সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ ও ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাজেই সরকারি চাকুরিতে যোগদানের পূর্বে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মানবিকতার প্রশিক্ষণ জরুরী বলে মনে করছি, যার প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের নিকট প্রদেয় সেবার মান বর্তমান অবস্থা থেকে আরও উন্নত হবে।
দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবায় নেই মানবিকতা, দখল করে নিয়েছে বাণিজ্য। এ কারণে সরকারি নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা। সুযোগ নিয়ে সরকারি বেসরকারি হাসপাতালে ও ডাক্তাররা ইচ্ছামতো ভিজিট নির্ধারণ করেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর যেন বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করছে। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এভাবে একই রোগের চিকিৎসার জন্য একেক ডাক্তার একেক রকম ভিজিট নেওয়ায় মানুষের হয়রানির সীমা থাকে না। মিরপুরের গৃহবধূ সাদিয়া খুঁজছিলেন গাইনি ডাক্তার। পরিচিত একজনের কাছ থেকে গাইনি ডাক্তার ক এর নাম শুনে তাঁর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার জন্য খোঁজখবর নেন। কিন্তু ভিজিট শুনেই খেপে ওঠেন।প্রথম ভিজিটই যদি ৭০০ টাকা দিতে হয় তাহলে এই ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করাব কিভাবে? বাংলাদেশে অন্য কোনো গাইনি ডাক্তারের এত টাকা ভিজিট আছে বলে তো শুনিনি।
এই ডাক্তার কি শুধু বড়লোকদের চিকিৎসা করবেন? গরিব রোগীদের কি তাঁর সেবা পাওয়ার অধিকার নেই। প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টার ডাক্তার দেখাতে আসা রোগী মোঃ জামাল বলেন, সত্যিই যেন এখন বেশির ভাগ ডাক্তার একরকম টাকার মেশিন হয়ে উঠছেন, যা নীতিহীন ও অন্যায়। এতে রোগীরা কেবল হয়রানির শিকারই হচ্ছে না, চিকিৎসা করাতে এসে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারও দায় এড়াতে পারে না। কারণ নাগরিকসেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। ডাক্তারদের ভিজিট ও কমিশন নিয়ে যে প্রকাশ্য বাণিজ্য চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল, কুষ্টিয়া তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, এই বিষয়ে আমার বক্তব্য দেওয়ার কোন এখতিয়ার নেই। এই বিষয়গুলো ইগউঈ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেখে।
বিএমএ কুষ্টিয়ার সাধারণ সম্পাদক ডা. আমিনুল হক রতন বলেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে একজন ডাক্তার কিংবা উকিল কত টাকা নেবে এ বিষয়ে সরকার বা রাষ্ট্রের কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এটা একটা অনেক বড় সমস্যা। ডাক্তার তাদের নিজের ইচ্ছামত ভিজিটের ফি নির্ধারণ করে নেয়। আমরাও চাই এই বিষয়ে রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট বিধি থাকা উচিত। সিভিল সার্জন কুষ্টিয়া ডাঃ মোঃ আকুল উদ্দিন বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এমন কোন সুনির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নেই যে কোন ডাক্তার কত টাকা ফ্রি নেবে। যার কারণে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারা একরকম নেয় এবং প্রফেসররা একরকম ফি নিয়ে থাকে। আগামীতে সংস্কারের যে প্রক্রিয়া চলছে এর মধ্যে এই বিষয়গুলো রয়েছে তাই আমরা আশা করে অচিরে এর সমাধান পাব।
