নিজ সংবাদ ॥ কুষ্টিয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই জেলা জুড়ে লাইসেন্সবিহীন ইটভাটার ছড়াছড়ি। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বছরের পর বছর চলছে অবৈধ ইটভাটা। সরকারী নীতিমালা ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করে কৃষিজমিতে গড়ে ওঠা ঐ ইটভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে বনজ সম্পদ উজাড়ের পাশাপাশি কৃষিজমি নষ্ট, ফসলহানি ও পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটছে মারাত্মক ভাবে। জেলায় ২১৮টি ইটভাটার মধ্যে অনুমোদিত মাত্র ১৫টি। অন্য ২০৩টি চলছে পরিবেশের ছাড়পত্র ও লাইসেন্সবিহীন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলায় কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে ২১৮টি ইটভাটা। এর মধ্যে ১২০ উচ্চতার পাকা ফিক্সড চিমনির ৯৬টি, জিগ-জ্যাগ ৬৫টি ও মাত্র ৩০/৪০ উচ্চতাসম্পন্ন ড্রাম চিমনির ইটভাটা ৪১টিসহ মোট ২০৩টি লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা। সরকারি আইনে কৃষি নষ্ট করে ইটভাটা স্থাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কিন্তু তা সত্ত্বেও কমপক্ষে প্রতিটি ইটভাটার জন্য তিন-চার একর কৃষিজমি নষ্ট করে ইটভাটা স্থাপন করেছে প্রভাবশালীরা। আইনের ফাঁক-ফোকর ডিঙিয়ে জেলায় গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ ইটভাটা। প্রতি বছরের মতো এবারও চলতি মৌসুমের শুরুতেই কৃষিজমি ও নদীর পলি মাটি কেটে ইটভাটাগুলোতে প্রস্তুত করা হচ্ছে নতুন ইট। এতে জেলায় কৃষিজমি হ্রাস ও উদ্বেগজনকভাবে কমছে খাদ্যশস্য উৎপাদন। ভাটার লাইসেন্স পেতে প্রস্তাবিত আবেদন পত্রের সঙ্গে ইট তৈরিতে মাটির উৎস উল্লেখ করে জেলা প্রশাসকের কাছে হফলনামা দাখিলের বাধ্যতামূলক শর্ত থাকলেও ভাটা মালিকদের অধিকাংশই তা মানছে না। ফলে বেআইনিভাবে কৃষিজমি ও নদী তীরের পলি মাটি কেটে প্রস্তুত করা হচ্ছে ইট। অন্যদিকে ভাটাগুলোতে কয়লার পাশাপাশি দেদার কাঠ পুড়িয়ে উজাড় করা হচ্ছে ফলদ-বনজ সম্পদ।
ইটভাটার নির্গত ধোঁয়া-ছাই ফসলের ক্ষতিসহ পরিবেশ দূষণসহ জনজীবন ক্ষতিগ্রস্ত করছে চরমভাবে। তবে প্রতি বছর কিছু সংখ্যক ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও পরবর্তী সময়ে তা আর এগোয়নি বেশি দূর। ইটভাটা মালিক সমিতির শক্তিশালী সিন্ডিকেটের প্রভাব, অর্থবিত্ত ও তদবিরে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা অবৈধ ভাটা সম্পূর্ণরূপে উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না বলে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এছাড়া কতিপয় ভাটা মালিক উচ্চ আদালতের দারস্থ হয়ে সৃষ্টি করেছে আইনি প্রতিবন্ধকতা। ফলে আইনি জটিলতার পাশাপাশি প্রশাসনিক নির্লিপ্ততায় অবৈধ ইটভাটা বন্ধসহ থামছে না গাছপালা নিধন তৎপরতা। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি ও কৃষিজমি বিনষ্ট করে ইটভাটা স্থাপনের পরিবর্তে কংক্রিট ঢালাইয়ের আদর্শ মানসম্পন্ন ব্লক ইট ব্যাপকভিত্তিক উৎপাদন ও সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ইমারত নির্মাণে তা ব্যবহারে জোর তাগিদ দেন স্থানীয় সচেতন মহল। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর কুমারখালীর পদ্মা নদী বেষ্টিত চরসাদিপুর ইউনিয়নে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালায় পরিবেশ অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন।
কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলার তিনজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও ফায়ার সার্ভিসের ১০০ জনের একটি সুসজ্জিত দল উপজেলার চরসাদিপুর ইউনিয়নের ভোমরার মোড়ে গেলে অবৈধ ইটভাটা মালিক ও শ্রমিকরা তাদের অবরুদ্ধ করেন। অভিযান পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়ে তিন ঘণ্টা পর ‘আগামী বছর আর অবৈধ ভাটা চলাব না’ মর্মে ইটভাটা মালিকদের কাছ থেকে সাদা কাগজে মুচলেকা নিয়ে ফিরে যান প্রশাসনের লোকজন। রাষ্ট্রীয় কাজে বাধা দেওয়াসহ তিনটি আইনে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চরসাদিপুরের এবিসি ব্রিকসের মালিক সাখাওয়াত মোল্লা, এমবিএল ব্রিকসের আজাহার, আরএফএল ব্রিকসের ইকবাল হোসেন, এমআরবি ব্রিকসের পান্না ইসলাম, ভিআইপি ব্রিকসের ওয়াসিম উদ্দিন, এজেডবি ব্রিকসের শাহাবুদ্দিন, আরজেডবি ব্রিকসের রবিউল, এএসবি ব্রিকসের শরিফুল ইসলাম, একতা ব্রিকসের বকুল ও ফাইভ আর ব্রিকসের জাকিরের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তর। কুষ্টিয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সিনিয়র ক্যামিস্ট হাবিবুল বাসার বাদী হয়ে কুষ্টিয়ার পরিবেশ আদালতে এসব মামলা করেন।
এর আগে সোমবার (২ ডিসেম্বর) কুষ্টিয়ায় চার ইটভাটা মালিককে ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় একটি ইটভাটা আংশিক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই সাথে মিরপুর উপজেলার চারুলিয়া ও আমকাঠালিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে জরিমানার আদেশ দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মমতাজ বেগম। জানা যায়, পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র না থাকায় তাদের প্রত্যেকের দেড় লাখ টাকা করে মোট ছয় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে এএসএম ইটভাটা আংশিক গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সেখানেও মালিক ও শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়েন পরিবেশ অধিদফতরের ভ্রাম্যমাণ আদালত। বাধার কারণে শেষ পর্যন্ত মাত্র দুই ঘণ্টা নামমাত্র অভিযান পরিচালনা করেই কুষ্টিয়ায় ফিরে আসতে বাধ্য হন তারা। কুমারখালীর দশ ইটভাটা মালিকের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর কুষ্টিয়ার সিনিয়র কেমিস্ট ও ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক মো. হাবিবুল বাশার জানান, মামলা আমরা করেছি এটা কোর্টের এখতিয়ার। তবে আমার জানা মতে তাদের বিরুদ্ধে সম্ভবত কোর্ট সমন জারি করেছে। অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুব শিঘ্রই অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অবৈধ ইটভাটার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, আমরা নিয়মিত পদক্ষেপ নিচ্ছি। ছোট ছোট যে সমস্ত বিষয়ে আমাদের সামনে আসছে সে সকল বিষয় নিয়ে আমরা কাজ করছি। নিয়মিত বিরতিতে পদক্ষেপ চলবে।
