মিজানুর রহমান নয়ন, কুমারখালী ॥ অন্ধকারাচ্ছন্ন মঞ্চে পরপর তিনটা ঘণ্টা ধ্বনি। মঞ্চের আলো ঝাপসা হয়ে যায়। জমিদারী চরিত্রে একজন বলছেন, ‘ চাষার হাতে গোলাপ ফুল। ‘ তোষামদে চরিত্রে আরেকজন বলছেন ‘ গোবরে পদ্মফুল হুজুর। ‘ এ কথা শুনে জমিদার দাঁত কামড়িয়ে বললেন, ‘ গোবর কোথায় পেলে? পাকা আম, হারামজাদা দাঁড়কাক।’ তখন দর্শকরা হাসতে হাসতে করতালি দিতে থাকেন। এ সময় মঞ্চে জ্বলে উঠে আলো। দেখা গেল জমিদারী পোশাকে এক যুবক এবং সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরিধান করা আরো দুই যুবক।
গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর লাহিনীপাড়ায় অমর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটার মঞ্চে এ দৃশ্য দেখা যায়। এরপর রাত পৌণে ১১টার দিকে হঠাৎ আবার ঘণ্টা বাজল। মঞ্চে দেখা যায়, খাজনা পরিশোধ না করা কৃষক চরিত্রে আবু মোল্লা মহাসংকটে পড়েছেন। কোরানশরীফ থেকে আয়াত পাঠ হচ্ছে। পর্দায় ফাঁসির দড়ি ঝুলছে। আবু ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন আবেগ আপ্লুত হয়ে কেঁদে দেন অনেকেই। প্রায় ১২ ফুট দীর্ঘ মঞ্চটিতে মঞ্চায়িত নাটকের নাম ‘ জমিদার দর্পন’। এখানে ফুটিয়ে তোলা হয় তৎকালীন গ্রামীণ জীবন ব্যবস্থা ও জমিদারদের শাষণ, শোষণ – নিপীড়নের চিত্র। এতে কুমারখালী শিল্পকলা একাডেমীর প্রায় ২২ জন শিল্পী অংশ নেন। লাহিনীপাড়ার মীর মশাররফ হোসেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মো. ফাহিম জানায়, প্রথমবারের মতো মঞ্চনাটক দেখছে।
অনেক মানুষ এসেছে। খুব ভাল লাগছে তার। একই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী রিপা খাতুন জানায়, সাধারণত টিভি বা মোবাইলে নাটক দেখা হয়। এভাবে সরাসরি চোখের সামনে এমন নাটক দেখা এবার দিয়ে দ্বিতীয়। তাঁর ভাষ্য, মোবাইলের চেয়ে মঞ্চ নাটক বেশি আনন্দদায়ক এবং স্ষ্ঠু বিনোদন। এক নারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, লাহিনীপাড়ার বাসিন্দা তিনি। সাংসারিক কাজ সেরে প্রতিবারের ন্যায় নাটক দেখতে এসেছেন। এবার সঙ্গে ছিল ছেলের বউ ও নাতি। তাঁর ভাষ্য, নাটকে জমিদারদের অন্যায় অত্যাচার, জুলুম দেখে চোখ দিয়ে আপনাআপনিই পানি বের হয়ে গেছে।
নাটকে মীর মশাররফ হোসেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান মানু। তিনি জানান, জমিদার দর্পণ একটি বাস্তব ধর্মী নাটক। এখানে জমিদার ব্যবস্থার কুফল এবং সাধারণ মানুষের উপর জমিদারদের নির্মম নির্যাতনে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। জানা গেছে, ১৩ নভেম্বর ছিল অমর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৮তম জন্মজয়ন্তী। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম দিকপালের জন্মজয়ন্তীতে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের লাহিনীপাড়ায় তাঁর বাস্তুভিটায় দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। এতে সহযোগীতা করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়।
বৃহস্পতিবার বিকেলে লাঠিখেলার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিষাদ-সিন্ধু রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের জন্মোৎসব। এ দিন সন্ধায় আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মো. জাহাঙ্গীর আলম। এরপর রাতে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চায়িত হয় কবির লেখা নাটক ‘ জমিদার দর্পণ’।
গতকাল শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) ছিল আয়োজনের শেষ দিন। এই দিন সন্ধায় আলোচনা সভা শেষে কথাসাহিত্যিকের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রাতে মঞ্চায়িত হয় কবির লেখা উপন্যাস বিষাদসিন্ধু অবলম্বনে নাটক ‘ এজিদের পরিণতি ‘। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম বলেন, লাঠিখেলা, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক ও নাট্যানুষ্ঠান এবং গ্রামীণ মেলার মধ্যদিয়ে অমর কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৮ তম জন্মজয়ন্তী শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপিত হয়েছে।
