কুমারখালী প্রতিনিধি ॥ কেউ ফিতা মেপে কাপড় কাটেন। কেউ কাটা কাপড় মেশিনে সেলাই করেন। কেউবা ইস্ত্রি করেন বানানো পোশাক। ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বছর ঘুরে এভাবেই ব্যস্ত সময় পার করেন দর্জিপাড়ার কারিগররা। তাদের এই ব্যস্ততা চলে চাঁদ রাত পর্যন্ত। তবে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চিত্র সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা ভিন্ন। কয়েক বছর ধরে দর্জিপাড়ায় চিরচেনা ব্যস্ততা নেই। আগের চেয়ে দর্জি দোকানের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি কারিগরের সংখ্যা। সারা বছর তেমন কাজ না থাকায় কেউ কেউ পেশাও বদল করেছেন। কারিগরদের ভাষ্য, তৈরি পোশাক শিল্পের (রেডিমেইড গার্মেন্ট) ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বাজারে কম দামের তৈরি পোশাকে সয়লাব। ফলে দর্জিপাড়ায় কমে যাচ্ছে ব্যস্ততা। কুমারখালী পৌর শহর, যদুবয়রার জয় বাংলা বাজার, চাঁদপুর, চৌরঙ্গী, পান্টিসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে এ চিত্র পাওয়া গেছে। যে কোনো উৎসব বা ঈদে মানুষ সাধারণত দুই ধরনের পোশাক পছন্দ করে। একটা হলো তৈরি করা পোশাক। অন্যটা হলো পছন্দসই কাপড় কিনে দর্জির মাধ্যমে নিজের ইচ্ছামতো বানানো পোশাক। দর্জিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটা সময় মানুষ দর্জির কাছ থেকে বানানো পোশাকই বেশি পছন্দ করতেন। তখন দর্জিরা মেশিনে আওয়াজ তুলে রাতভর কাজ করতেন। কিন্তু খরচ কম হওয়ায় এখন মানুষের মাঝে তৈরি করা পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। এ জন্য ঈদ ঘনিয়ে এলেও দর্জিপাড়ায় ব্যস্ততা নেই। প্রায় ১০ বছর আগে কুমারখালী সদরবাজারে ৮-১০টি দর্জির দোকান ছিল। সে সময় দল বেঁধে প্রায় ৪০-৫০ জন দর্জি কাজ করতেন। বর্তমানে দোকানের সংখ্যা ১৫-১৮টি। তবে বাড়েনি দর্জির সংখ্যা। কুমারখালী পৌরসভার নিউ ঢাকা টেইলার্সের মাস্টার অমল চন্দ্র শর্মা প্রায় ৩০ বছর ধরে দর্জির কাজ করছেন। তাঁর ভাষ্য, দিনে দিনে দর্জির দোকান বাড়লেও দর্জি বাড়ছে না। এ কাজ শিখতে সময় লাগে। তাই নতুন কেউ শিখছেন না। তিনি বলেন, এ কাজে সম্মান ও সম্মানী কম। তাই দিনে দিনে কারিগর কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া বাজারে অল্প দামে তৈরি পোশাক পাওয়া যায়। শুধু চাকরিজীবীরা বাধ্য হয়ে পোশাক বানান। একই টেইলার্সের দর্জি কামাল হোসেন জানান, সারা বছরে শুধু রমজানে কাজের চাপ বাড়ে। এখন প্রতিদিন তিনি ৩-৪টা শার্ট (জামা) বা প্যান্ট তৈরি করেন। কিন্তু অন্য সময় দিনে একটা-দুটিরও অর্ডার থাকে না। শহরের অনুপম টেইলার্সের দর্জি সুভাষ দত্তের কারখানায় আটটি সেলাই মেশিন। কিন্তু অর্ডার কম থাকায় মাত্র চারজন দর্জি কাজ করছেন। তাঁর ভাষ্য, তৈরি পোশাকশিল্পের প্রসারের কারণে দর্জিরা অসহায় হয়ে পড়েছেন। দর্জির মজুরির টাকায় এখন তৈরি পোশাক পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর প্রতিটি প্যান্ট তৈরির মজুরি নেওয়া হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকা, জামা ৩৫০-৪০০, পাঞ্জাবি ৪৫০-৫৫০ এবং থ্রিপিস ও টুপিসের মজুরি নেওয়া হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা। দর্জি তরিকুল ইসলাম জানান, এক সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের মহেন্দ্রপুর গ্রামের মো. আশরাফুল ইসলাম। তিনি পেশা বদল করে গরুর খামার করেছেন। এ বিষয়ে আশরাফুলের ভাষ্য, সারা বছর তেমন কাজ থাকে না। সংসারের খরচ মেটানো যায় না। করোনার সময় তাঁর খুব দুর্দিন গেলেও সরকারি কোনো সহায়তা পাননি। তাই তিনি দর্জির কাজ ছেড়ে জমানো টাকা ও ঋণ নিয়ে খামার করেছেন। ২৪ বছর ধরে দর্জির কাজের সঙ্গে যুক্ত আইডিয়াল টেইলার্সের কাটিং মাস্টার আখতার হোসেন। তিনি বলছিলেন, করোনাকালে ব্যবসা মন্দা গেছে। আর এ বছর নিত্যপণ্যের দাম বেশি। তাই মানুষের পোশাকের চেয়ে অন্যদিকে নজর বেশি। ফলে এ বছরও ব্যবসা মন্দ। তবে একটু দেরিতে হলেও এ বছরও কাজের চাপ বেড়েছে বলে জানালেন যদুবয়রার ইউনিয়নের জয় বাংলা বাজারের দর্জি মিলন হোসেন। তিনি এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি অর্ডার নিয়েছেন। ১৫ রোজা পর্যন্ত অর্ডার নেওয়া হবে। আর কাজ চলবে চাঁদ রাত পর্যন্ত। কুমারখালী দর্জি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কাজী মো. হাফিজুর রহমান। তিনি ২০২১ সালে সংগঠনটি করেছেন। এই সংগঠনের সঙ্গে ১৪০ জন দর্জি যুক্ত। তিনি বলেন, তৈরি পোশাকের কারণে দর্জির কাজ কমলেও যে কোনো মূল্যে আদিম এ পেশাকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
