এসপি তানভীর আরাফাত আমাকে ফাঁসিয়েছে: জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি - কুষ্টিয়া জিলাইভ | truth alone triumphs

এসপি তানভীর আরাফাত আমাকে ফাঁসিয়েছে: জেলা আ’লীগের সহ-সভাপতি

লেখক: প্রতিবেদক ঢাকা
প্রকাশ: আগস্ট ৩, ২০২৪

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ কুষ্টিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি করে শত কোটি টাকার জমি হাতিয়ে নেওয়ার মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দিয়েছে সিআইডি পুলিশ। গত মঙ্গলবার (জুলাই ৩০) কুষ্টিয়া আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ এ অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

গতকাল শুক্রবার (২ আগস্ট) বিকালে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (সিআইডি) জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, কুষ্টিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি মামলায়  ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। ৬ জন সরকারি চাকুরিজীবি থাকায় এবং তাদের অভিযোগ দুদকে থাকায় চার্জশীটে ৩৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। ওই ৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অভিযোগ অস্বীকার করে জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী রবিউল ইসলাম এসপি তানভীর আমাকে ফাঁসিয়েছে। আমি তৎকালীন সময়ের পুলিশ কর্মকর্তার সম্পূর্ণ আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। আমার নামে মামলাটি তাদের মনগড়া।

আমার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যাব। সত্যের জয় হবে ইনশাল্লাহ। এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে ২০২০ সালের দীর্ঘ তিন মাসের লকডাউন শেষে মানণীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লকডাউন ওপেন করে দেন। প্রধান মন্ত্রী বলেন, আগামীকাল থেকে সকল শপিংমল ও ব্যবসা বানিজ্য, জীবন ও জীবিকাকে পাশাপাশি রেখে চলার জন্য এটা খুলে দেওয়া হলো। তবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে এবং সামাজিক দুরুত্ব বজায় রেখে দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে হবে। দোকান মালিকরা দোকান খুলে রাখায়, পুলিশ এসে দোকানপাট বন্ধ রাখার জন্য লাঠি চার্জ করেন। আমি তখন চেম্বার অফ কর্মাসের সভাপতি ছিলাম। তাই আমাকে প্রতিবাদ করতে হয়েছে। আর এই জোরালো প্রতিবাদ করায় শুরু হলো ডিসি অফিসে মিটিং শুরু হয়। মিটিংএর ভিতর আমি এসপি তানভীর আরাফাতকে বলেছিলাম, আপনি এসপি হবার সুবাদে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসাবে আপনাকে সবার আগে এটা মানতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী গতকাল ০৯ এপ্রিল ২০২০ তারিখে ঘোষনা দিয়েছেন সমস্ত দোকানপাট খোলা থাকবে, আপনি এসে লাঠি চার্জ করলেন কেন? এসপি তানভীর আরাফাত বলেন, আমাদের কুষ্টিয়াতে মৃত্যুর হার বেশি তাই দোকানপাট খোলা যাবে না। আমি তখন বললাম, প্রধানমন্ত্রীতো আর এ কথা বলেনি, যেখানে মৃত্যুর হার বেশি, সেখানে দোকানপাট খোলা যাবে না। যেখানে মৃত্যুর হার কম সেখানে দোকানপাট খোলা থাকবে। যেখানে দেশের সকল দোকানপাট খুলে দেওয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আপনি এসপি সাহেব এসে বেধড়ক লাঠিপেটা করছেন না খেয়ে থাকে মানুষের উপর। এভাবে মারলেন কেন? এই নিয়ে আমার সাথে এসপি তানভীর আরাফাতের বিরোধ শুরু হয়। এসপি তানভীর আরাফাত কথা যে, প্রকাশ্য শত শত মানুষের মাঝে আমাকে জোরে কথা বলে কিভাবে। প্রধানমন্ত্রী কথা ডিসি, এসপি শুনবে না সেখানে কেন প্রতিবাদ হবে না আর এই প্রতিবাদ করতে গিয়ে এসপি তানভীর আরাফাত সাত মাস পরে একজনকে ধরে নিয়ে ১৬৪ ধারায় আমার বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। সে (এসপি তানভীর আরাফাত) আমাকে ফাঁসিয়েছে। সেও এই মামলা আসামী না তাকে দিয়ে আমাকে জালে ফেলেছে। এসব কথা আমি আদালতে খুলে বলবো।

ভুক্তভোগী ও মামলার বাদী কুষ্টিয়া শহরের বাসিন্দা এম এম এ ওয়াদুদ বলেন, আমি সহ আমার পরিবারের আরও ৫ সদস্যদের নাম ও তথ্য দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে আসামিরা। আমাদের নামে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে আমার শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৭ সাল থেকে তারা এগুলো শুরু করে। এরপর বিষয়টি জানতে পরে আমি মোট ৮ থেকে ১০টি মামলা করি। এ ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত রায়ের দাবি জানাচ্ছি। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন- কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান, কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি, জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হাজী রবিউল ইসলাম, জাহানারা বেগম, আমির হোসেন, সদর উদ্দিন, পিঞ্জিরা খাতুন, আঞ্জেরা খাতুন, ফারুক মন্ডল, মুহিবুল ইসলাম, জাহিদুল ইসলাম, মহিবুল ইসলাম, খালিদ বীন সাদী, হালিম উদ্দিন, আশরাফুজ্জামান সুজন, খয়বার শেখ, রঙ্গিলা খাতুন, মহিরন খাতুন, হারুনুর রশিদ, আমিরুল ইসলাম, হুর আলী, সুমন হোসেন, কামরুজ্জামান কাবিল, দেলোয়ার হোসেন, মিন্টু খন্দকার, জরিনা খাতুন, মোমেনা খাতুন, জীবন খাতুন, ছানোয়ারা খাতুন, হেনা, জাহানারা, মিলন হোসেন, নজরুল ইসলাম, মোস্তফা করিম, মোরশেদুল হাসান, ছরোয়ার হোসেন। মামলার অভিযোগে উল্লেখ্য করা হয়, ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডের বাসিন্দা এম এম এ ওয়াদুদ ও তার পরিবারের ৫ সদস্যদের নাম ও তথ্য দিয়ে জাল জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়।

ছয় ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে ভুয়া মালিক সাজিয়ে ওয়াদুদের শত কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর বিষয়টি জানাজানি হলে জালিয়াতির অভিযোগে ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জেলার রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ ১৮ জনের নামে প্রথমে মামলা হয়। পরে আরও বেশকয়েকটি মামলা হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। সেইসব মামলা চলমান রয়েছে। সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রটি ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে কুষ্টিয়া সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে দলিল সম্পাদন এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাদীর প্রায় ১০০ কোটি টাকা মূল্যের বাড়িসহ ভূ-সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করেন আসামিরা।

আদালতে গ্রেপ্তারদের দেওয়া স্বীকারোক্তিতে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার কথা উঠে আসায় অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডি পুলিশকে ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর মামলাটির তদন্ত ভার দেওয়া হয়। এ ঘটনা জানাজানি হলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে ঘটনা তদন্তে নামে নির্বাচন কমিশন। তদন্তে কুষ্টিয়া জেলা নির্বাচন অফিসের তৎকালীন কর্মরত পাঁচ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এনআইডি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২১ সালের ৪ মার্চ চার নির্বাচন কর্মকর্তা ও এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুইটি মামলা দায়ের করা হয়। কুষ্টিয়ার জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আনিসুর রহমান বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি ও জেলার কুমারখালী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করেন। দুটি মামলাতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি ধারা ব্যবহার করা হয়েছে। কুষ্টিয়া মডেল থানায় দায়ের হওয়া মামলার আসামিরা হলেন- ঢাকার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপসচিব (সাবেক জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) নওয়াবুল ইসলাম, ফরিদপুরের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) জিয়াউর রহমান, মাগুরা সদরের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) অমিত কুমার দাস ও কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক জিএম সাদিক। কুমারখালী থানায় দায়ের হওয়া মামলার একমাত্র আসামি হলেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (সাবেক কুমারখালী উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা) ছামিউল আলম।

দায়ের হওয়া মামলা তদন্ত করতে গিয়ে জালিয়াতিতে আনিসের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পায় সিআইডি। সে সময় জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গ্রেপ্তারের পর কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আনিসুর রহমান আনিস। তাদেরকে  দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।