বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। তার চাচাতো ভাই কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতা। তিনি সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ শাসনামলের গত ১৬ বছরে এই দুই ভাই মিলে কুষ্টিয়ার সবকিছু লুটেপুটে খেয়েছেন। ঠিকাদারি কাজ, হাট, ঘাট, বালুমহালসহ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এই দুই ভাইয়ের দুর্নীতির নগ্ন থাবা বসেনি। কেবল সাধারণ মানুষই নয়, আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারাও এ সময়ে হানিফ-আতার হাতে জিম্মি হয়ে পড়েন।
কেবল দেশে নয়, বিদেশেও দুই ভাই বাড়ি-গাড়ি কিনেছেন বলে প্রচার রয়েছে। মাহবুব উল আলম হানিফ কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার মানুষ মাহবুব উল আলম হানিফ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট আত্মীয়। সেই সূত্র ধরে হঠাৎ করে দলের নতুন মুখ হানিফ কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চাইলেও ওই আসন জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
নির্বাচনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হন হানিফ। ২০১৪ সাল থেকে শুরু করে সবগুলো সংসদ নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হন। এরই মধ্যে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে দলের যুগ্ম সম্পাদক হন। এর পর থেকে তার আঙুলের ইশারায় চলতে হতো কুষ্টিয়ার আওয়ামী লীগ নেতাদের। আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের শাসনামলে ক্ষমতার দাপটে হানিফ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
কুষ্টিয়ার সব ঠিকাদারি কাজ, হাট-ঘাটের ইজারা, সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতে নিয়োগ, পদ্মা ও গড়াই নদীর বালুমহাল থেকে শুরু করে সবক্ষেত্র থেকে কমিশন আদায় করেছেন হানিফ। এমনকি আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসহযোগী সংগঠনের পদ বিক্রির অভিযোগও রয়েছে হানিফের বিরুদ্ধে। অবৈধভাবে অর্জিত টাকায় তিনি খুলনায় বিশাল মাছের ঘেরসহ নামে-বেনামে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছেন। কানাডায়ও রয়েছে তার নিজস্ব বাড়ি। হানিফ কুষ্টিয়ার রাজনীতি ছাড়াও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি স্কুল কমিটির সভাপতি কে হবে, সেটাও নির্ধারণ করে দিতেন হানিফ। তিনি এমপি হলেও মন্ত্রীর থেকে বেশি প্রটোকল পেতেন।
কুষ্টিয়ায় এলে সামনে ও পেছনে থাকত পুলিশের ভ্যান। এ ছাড়া স্পেশাল সিকিউরিটি পেতেন তিনি। হানিফ কুষ্টিয়ায় এলে ঘিরে রাখত ব্যবসায়ীদের একটি দল। তাদের কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা কথা বলার মতো সুযোগও পেতেন না। কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডে জমি কিনে ২০১৩ সালের দিকে তিনতলা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন। ঢাকায় থেকে এসে এ বাড়িতে বসেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। দলের নেতাদের বাদ দিয়ে তিনি বিএনপি-জামায়াতপন্থি ব্যবসায়ী ও নেতাদের সঙ্গে আঁতাত করে তাদের কাছে ভেড়ান। তাদের মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে সব প্রতিষ্ঠান থেকে লুটে নেন কোটি টাকা।
বিশেষ করে খাজানগর এলাকার তিনজন চালকল মালিকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ফ্রেস এগ্রো ফুড, দেশ এগ্রো ফুড, মেসার্স সুবর্না অটোমিলের মালিকের সঙ্গে তার দহরম ছিল বেশি। একই সঙ্গে কুষ্টিয়ায় খাদ্য সংগ্রহ থেকে কোটি কোটি টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে বিগত ১৬ বছরে। এ টাকার বড় একটি অংশ দিয়ে কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডে আওয়ামী লীগের দলীয় অফিস নির্মাণ করেন হানিফ।
আতার উত্থান যেভাবে- আতাউর রহমান আতা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামের প্রয়াত আব্দুস সাত্তারের ছেলে। আব্দুস সাত্তার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের বাবা আফসার আলীর চাচাতো ভাই। সেই সূত্রে হানিফ আর আতা চাচাতো ভাই। হানিফের পর আতা ছিলেন কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি। দুই ভাই মিলে জেলার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সব সরকারি কাজ ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। এভাবে আতা জিরো থেকে বনে গেছেন শতকোটি টাকার মালিক। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে চড়লেও এখন তার কোটি টাকার দামি একাধিক গাড়ি আছে। স্ত্রী পাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেও স্বামীর টাকায় সেও কোটিপতি ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও বাড়ি আছে আতার।
হানিফ দলের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ায় আতা ছিল সবার কাছে আতঙ্কের। দল-মত নির্বিশেষে সবাই আতাকে সামাল দিয়ে চলতেন। বিচার ও সালিশ থেকে সবখানে আতার কথাই ছিল শেষ কথা। বিএনপির কয়েকজন নেতা ছিল আতার ঘনিষ্ঠ। তাদের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। এমনকি সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনের আগে হানিফের ভোটের কথা বলেও কোটি কোটি টাকা নেওয়া হয়। দলের নেতারা বলেন, কোরবানির আগে গরু ও ছাগলও আসত উপহার হিসেবে।
দেশ ছাড়াও দেশের বাইরে আতার সম্পদ ও অর্থ আছে বলে শোনা যায়। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় আতার সেকেন্ড হোম আছে মনে করেন দলের অনেকে। আতার ঘনিষ্ঠ পৌর কাউন্সিলর মীর রেজাউল ইসলাম বাবুসহ বেশ কয়েকজনও টাকার মালিক বনে গেছেন। তারাও আতার দাপট দেখিয়ে কাউকে মানুষ মনে করতেন না। যাকে-তাকে মারধর করতেন যখন-তখন। অর্থবিত্তে-সম্পদে ফুলেফেঁপে ওঠেন আতাউর রহমান আতা।
২০২২ সালে আতার বিপুল অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে একটি অভিযোগ জমা পড়ে। এতে বলা হয়, ১০ বছরের ব্যবধানে ভাই হানিফের প্রভাব আর আওয়ামী লীগের পদপদবি ব্যবহার করে বাড়ি-গাড়িসহ ১১০০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে গেছেন আতা। এই অভিযোগ ওঠার পর ২০২২ সালে দুদক আতার অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে। আতা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কুষ্টিয়া অফিস থেকে সাড়ে ৫ কাঠার প্লট নিয়েছেন।
শহরের হাউজিং এলাকায় ওই জমিতে ৭ তলা ভবনের কাজ চলছে। স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রীর নামে তিনি ওই সম্পদ করেছেন। এখানে বিনিয়োগের ব্যাপারে আয়কর নথিতে দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। অথচ ভবন করতেই খরচ হয়েছে ৫-৬ কোটি টাকা বলে আতা ঘনিষ্ঠ এক আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেছেন। এ ছাড়া কুষ্টিয়া হাই স্কুল মার্কেটে ১২টি, পরিমল টাওয়ারে দুটি ছাড়াও জেলা পরিষদ মার্কেট, সমবায় মার্কেটসহ বিভিন্ন মার্কেটে তার একাধিক দোকান আছে। শহরের বটতৈল এলাকায় জেলা পরিষদ মার্কেটের আটটি দোকান নিজ ও স্ত্রীর নামে বরাদ্দ দিয়েছেন। একই মার্কেটে আরও চারটি দোকান আত্মীয়স্বজনের নামে বরাদ্দ নিয়েছেন।
ভেড়ামারায় ২৫ বিঘা জমি কিনে বাগান করেছেন। এ ছাড়া ২৪ শতাংশ জমি রয়েছে আতার। আতার নামে ব্যাংক এশিয়ার পাংশা, রাজবাড়ী শাখায় ২ কোটি টাকার ডিপোজিট রয়েছে এক হিসাবে। ব্যাংক এশিয়া কুষ্টিয়া শাখায় আতার চলতি হিসাবে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়। পূবালী ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখায় হিসাব রয়েছে আতার, যেখানে ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ডিপোজিট রয়েছে। উত্তরা ও রূপালী ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখায় আতার নামে ডিপোজিট আছে।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক কুষ্টিয় শাখা আতার স্ত্রী সাম্মিয়ারার নামে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ডাবল বেনিফিট স্কিম, ন্যাশনাল ব্যাংক কুষ্টিয়া শাখায় সমপরিমাণ টাকার ডাবল বেনিফিট স্কিম ডিপোজিট রয়েছে। আতা ঢাকার গুলশানে ৪০০০ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাট কিনেছেন, যার মূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকা। এসব সম্পদ ছাড়াও কুষ্টিয়া শহরের কয়েকটি বহুতল ভবনে একাধিক ফ্ল্যাট ছাড়াও নামে-বেনামে তার সম্পদ রয়েছে নানা জায়গায়।
আতা ভেড়ামারা উপজেলায় আরও দুটি অংশে ১৫.১৮ শতাংশ জমি কিনেছেন, যার মূল্য ৬০ লাখ টাকার বেশি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর হানিফ ও আতার বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ায় দায়ের করা হয়েছে একাধিক হত্যা মামলা। তারা দুজনেই আত্মগোপনে। সরকার পতনের পর মাহবুব উল আলম হানিফের কুষ্টিয়ার আলিশান বাড়িতে হামলা করে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ উগরে দেয় ছাত্র-জনতা। বাড়ির জানালা-দরজা থেকে শুরু করে সব ফার্নিচার লুট হয়ে গেছে। এমনকি জানালাসহ বিভিন্ন জায়গার গ্রিল খুলে নিয়ে গেছে ক্ষুব্ধ লোকজন। এই ভুতুড়ে বাড়ি দেখতে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এখন ভিড় করছে মানুষ।
