বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সম্প্রতি অনলাইন জুয়ার এজেন্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে আইন-শৃংখলা বাহিনী। তবে কুষ্টিয়ার অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট রেজাউল রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে আত্মগোপনে চলে গেছেন ক্যাসিনো এজেন্ট রেজাউল ও তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য এবং সেগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির নেতিবাচক সুযোগ কাজে লাগিয়ে কুষ্টিয়া অঞ্চলে অনলাইনে গড়ে তোলা হয়েছে অপরাধের এই বিরাট সাম্রাজ্য।
পদে পদে দেওয়া হয় লোভনীয় অফার। যেগুলো মূলত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়ে শুধু অর্থ নয়, নৈতিক স্খলনও ঘটছে অনেকের। বারংবার কঠোরতা দেখিয়েও নানা ফাঁকফোকর আর কতিপয় অসাধু ব্যক্তিদের তৎপরতায় শেষপর্যন্ত নীরব পরাজয়ের শিকার হতে হচ্ছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্টদের। কুষ্টিয়ার অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাট রেজাউলকে ধরতে কয়েকবার অভিযান চালিয়েও প্রমাণের অভাবে ব্যর্থ হয় প্রশাসন। ফলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন গ্যাম্বলিং (জুয়া), বেটিং (বাজি) আর ক্যাসিনো। সূত্র জানিয়েছে, অনলাইন জুয়াড়িরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নানা কৌশল এঁটেছে।
হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রামে তারা এজেন্টদের সাথে যোগাযোগ করছে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছে অপ্রচলিত বিভিন্ন অ্যাপস। যারা জুয়া খেলেন তারাও এসব অ্যাপ ও নাম্বার ব্যবহার করছেন। প্রতিনিয়তই নম্বরগুলো বদলে ফেলছেন তারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, অনলাইন জুয়া পরিচালনা হচ্ছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাইট থেকে। ফেসবুক-ইউটিউবে প্রচার করা হচ্ছে এসব সাইটের বিজ্ঞাপন। বেটিং, ক্যাসিনো বা জুয়া বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও খুব সহজেই ওয়ান এক্স বেট, মেলবেট, বেট উইনার, জেটউইন বাংলাদেশ, মাইজেট, ক্রিকেক্স, বাজি ৩৬৫ ক্যাসিনোসহ (অন্যান্য বেটিং ও ক্যাসিনো ওয়েবসাইটের নাম অনুসন্ধানের স্বার্থে গোপন রাখা হলো) অনেক বেটিং ও ক্যাসিনোর ওয়েবসাইটে খুব সহজেই যুক্ত হওয়া যাচ্ছে।
এসব সাইটে টাকা ডিপোজিট করে স্লটস, ই-গেমস, টেবিল গেম, কার্ড গেম, ভিডিও পোকার ও লাইভ ক্যাসিনোতে অংশ নেওয়া যায়। যার কুষ্টিয়া অঞ্চলে এজেন্ট হিসেবে রয়েছেন এক সময়ের কাঠমিস্ত্রি ত্রিমোহনী এলাকার রেজাউল ইসলাম। অনলাইন জুয়ায় অস্বাভাবিক গতিতে ঘুরেছে তার ভাগ্যের চাকা। কাঠ মিস্ত্রি থেকে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। বিষয়টি নিয়ে নানা গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছে কুষ্টিয়া ত্রিমোহনী বারখাদা পূর্বপাড়া এলাকাতে। একজন কাঠমিস্ত্রি এতো টাকার মালিক কিভাবে হলেন বিষয়টি নিয়ে বেশ মজার কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। কেউ বলছে ১০০ কোটি, কেউ বলছে ৫০০ কোটি আবার কেউবা বলছে হাজার কোটি।
তবে তার প্রকৃত সম্পত্তির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন এলাকাবাসী। তবে এলাকাবাসী ধারণা করেন, আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছেন এই কাঠমিস্ত্রি। বারখাদা পূর্বপাড়ার এলাকার শুকুর আলীর ছেলে রেজাউল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রেজাউল একজন কাঠমিস্ত্রির ছিলো। তিন বছর আগেও তার আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। অভাব এবং ঋণের কারণে এলাকার মানুষের কাছ থেকে ধার-দেনাও করেছেন। ঋণের টাকা সময় মত পরিশোধ করতে না পারায় গাছের সাথে বেঁধে রাখারও বিষয়টিও জানা যায়। তবে একজন মানুষ রাতারাতি বিপুল পরিমান টাকার মালিক কিভাবে হলেন এনিয়ে রয়েছে নানা গুঞ্জন। তার আয় এবং সম্পদের মধ্যে রয়েছে সুবিশাল ফাঁক। প্রকাশ্যে কেউ মুখ না খুললেও সবাই জানেন কুষ্টিয়া অঞ্চলে অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসা করেই রেজাউলের এই উত্থান।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত তিন বছরে কাঠ মিস্ত্রী রেজাউল ক্রয় করেছেন একটি চারতালা বাড়ি, একটি দুই তলা বাড়ি। এছাড়াও কুষ্টিয়া শহরের আশে পাশে আছে রজনী ট্রেডার্স, রোজা ট্রেডার্স নামে একটি আসবাব পত্র তৈরির কারখানা। যেখানে রয়েছে কয়েক কোটি টাকার আধুনকি কাঠ প্রসেসিংয়ের বিদেশী মেশিন ও সরঞ্জাম। এছাড়াও তার কারখানায় সব সময় মজুদ কয়েক কোটি টাকার দামী দামী কাঠ। অনুসন্ধান কালে আরও জানা যায়, কুষ্টিয়া-ভেড়ামারা মহাসড়কের ৮ মাইল নামক স্থানে রাস্তার পাশে তার রয়েছে দুই বিঘা জমি। বর্তমান বাজার দরে যার প্রতি কাঠার মূল্য ৬ লক্ষ টাকারও বেশী।
এছাড়াও গুঞ্জন রয়েছে, দেশের বাইরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে (দুবাই) তার রয়েছে অঢেল সম্পত্তি। যার মধ্যে একটি বিলাস বহুল বাড়ী, ৬-৭টা দোকান এবং গাড়ী। এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, পেশায় কাঠ মিস্ত্রী হলেও রেজাউল অনেকটা ধূর্ত প্রকৃতির মানুষ। সেই কারণে যে কোন পরিবেশে নিজেকে সহজেই মিশে যেতে পারতেন। এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন উঠুক সেটা তিনি মোটেই চাইতেন না। যার ফলে আওয়ামী লীগের নেতা থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের সাথে গড়ে তুলেছিলেন বিশেষ সক্ষতা।
এছাড়াও বাংলাদেশের অনেক নামী দামি মানুষের সাথে ছিলো তার চলাফেরা। গত কয়েক মাস আগে রেজাউল এর পৃষ্টপোষকতায় ত্রিমোহনী বারখাদা হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ সব চেয়ে বড় টেপ টেনিস ক্রিকেটের ফাইনাল। সেই খেলায় খরচ করেছিলেন কোটি টাকার উপরে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ঢাকা থেকে এনেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সদস্যদের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুর বাশার সুমন, ইমরুল কায়েস, আফিফ হোসেন ধ্রুব, বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক জাহানারা আলম, বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ধারাভাষ্যকার আতাহার আলিসহ জেলা ও শহর আওয়ামী লীগের বাঘা বাঘা নেতাদের।
এছাড়াও জানা যায় তিনি কুষ্টিয়া সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আতার বিশ্বস্ত এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। আতাউর রহমান আতার মাধ্যমে তিনি জেলা আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যে কোন অনুষ্ঠান এবং প্রোগ্রাম সফল করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছেন। এবিষয়ে জানতে রেজাউলের মুঠোফোন ফোন দিলে তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কাঠ মিন্ত্রী রেজাউলের অবৈধ আয় এবং ব্যয় সম্পর্কে চোখ রাখুন পরবর্তি পর্বে।
