অবৈধ দলিল লেখক সমিতি ও সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নামে প্রতি মাসে কোটি টাকার চাঁদা আদায়
কুষ্টিয়ায় সাব রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল সম্পাদন করতে আসা সাধারন মানুষকে জিম্মি করে অবৈধ দলিল লেখক সমিতি ও সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের অফিস খরচের নামে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। দিনের পর দিন প্রকাশ্যে মানুষকে হয়রানী করে কোটি কোটি টাকা চাঁদা তুলে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন কয়েকজন দলিল লেখক, ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। রাজনৈতিক নেতাদের মদদ থাকায় বিষয়টি নিয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। সাধারন দলিল লেখকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও তারা ভয়ে কিছু বলতে পারে না।

অবৈধ দলিল লেখক সমিতি ও সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের নামে প্রতি মাসে কোটি টাকার চাঁদা আদায়
কুষ্টিয়া এনএস রোডে অবস্থিত সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে সদর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়ন ছাড়াও পৌর এলাকার জমি কেনা-বেচা হলে এ অফিসের মাধ্যমে দলিল সম্পাদন করা হয়। সদর সাব রেজিষ্টারের কার্যালয়ে সপ্তাহের তিন দিন মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার কাজ হয়। অফিসের হিসাব মতে, তিন দিনে গড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০টির বেশি দলিল সম্পাদন হয়। প্রতিমাসে সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৩০০ থেকে ৪০০টির বেশি।
অফিসের অফিস সহকারী রফিকুল ইসলাম বলেন,‘ সরকার রেজিষ্ট্রি খরচ বাড়ানোর কারনে দলিল সম্পাদন কমেছে। আগে অনেক বেশি হতো। এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।’ বর্তমানে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ১ লাখ টাকার দলিল হলে ক্রেতাকে কোষাগারে জমা দিতে হয় শহরের জন্য সাড়ে ১১ হাজার ও ইউনিয়নের জন্য সাড়ে ৭ হাজার টাকা। এ টাকার ব্যাংক রিসিট দেওয়া হয়। এ হিসেবের বাইরে একজন ক্রেতাকে দলিল সম্পাদন করতে অবৈধ দলিল লেখক সমিতিকে দিতে হয় প্রথম এক লাখের জন্য সাড়ে ৩ হাজার ও পরবর্তি প্রতি লাখে ১ হাজার। এর বাইরে সাব-রেজিষ্টার অফিসকে আলাদা সাড়ে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এই সাড়ে ৩ হাজার টাকার মধ্যে সাব-রেজিষ্টার পান ১০০০ হাজার, জেলা রেজিষ্টার নেন ৫০০ টাকা, অফিস সহকারি নেন ৫০০ টাকা, অফিস স্টাফরা সবাই মিলে নেন ১ হাজার টাকা ও বাকি ৫০০ টাকা দিতে হয় অবৈধ সমিতিকে। এর বাইরে আরো ১০০ থেকে ২০০ টাকা অফিসের স্টাফরা চেয়ে নেন।
কুষ্টিয়া সদর উপজেলার আব্দালপুর গ্রামের শারিনা খাতুন ২৫ অক্টোবর (বুধবার) একটি দলিল সম্পাদন করতে সাব রেজিষ্ট্রি অফিসে যান। সাব রেজিষ্টার কার্যালয়ের একজন দলিল লেখকের মাধ্যমে তিনি দলিল সম্পাদন করেন। ইউনিয়নে জমির অবস্থান হওয়ায় ৫ লাখ টাকার দলিল করতে তার সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয় ৩৮ হাজার টাকা। এছাড়া অবৈধ সমিতির নেতারা নেন সাড়ে ৭ হাজার টাকা, সাব-রেজিষ্টারের কার্যালয় থেকে নেওয়া হয় সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
বুধ ও বৃহস্পতিার (২৫ ও ২৬ অক্টোবর) সাব-রেজিস্ট্রারের কার্যালয় প্রায় ৫ ঘন্টা অবস্থান করে কমপক্ষে ১০জন ক্রেতার সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ১০জন ক্রেতাকেই দলির সম্পাদন করতে ৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবৈধ সমিতি ও অফিসকে দিতে হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিস্ট্রার অফিসে দলিল লেখক সমিতির (মুহুরী) একটি সমিতি রয়েছে। তবে সেই সমিতির সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। সভাপতি হিসেবে আছেন ওয়াহেদুজ্জামান লাইজু, সাধারন সম্পাদক হিসেবে পৌর কাউন্সিলর সোহেল রানা আশা ও ক্যাশিয়ার হিসেবে আমিরুল ইসলাম। নিবন্ধনহীন সমিতির বাৎসরিক কোন সভা ও এজিএমও হয় না।
একাধিক দলিল লেখকের সাথে কথা হলে বলেন,‘ মাঝখানে দলিল লেখক সমিতির কোন কার্যক্রম ছিলো না। ২০১৩ সালের পর তৎকালিন জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন অবৈধ সমিতির নামে চাঁদা তোলা বন্ধ করে দেন। তার আগেও ২০০৯ সালের পর তৎকালিণ পুলিশ সুপার সাহাবুদ্দিন খান অভিযান চালিয়ে সমিতির কার্যক্রম বন্ধ করে দেন। তবে কয়েক বছর আগে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাকে ম্যানেজ করে আবার কার্যক্রম চালু হয়েছে। প্রকাশ্যে মানুষের পকেট কেটে লাখ লাখ টাকা নেওয়া হলেও এ বিষয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারছে না।
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বিগত প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর ধরে কথিত সমিতি চালু করা হয়েছে। নাম মাত্র একটি কমিটি করে রাখা হয়েছে। নেই নির্বাচন ও কোন জবাবদিহিতা। ইচ্ছে মত টাকা তুলে খরচ করা হয়। এ টাকার ভাগ কোথায় কোথায় যায় তার হিসাব একমাত্র সভাপতি-সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতা জানেন। কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকায় বাড়ি আলফাজ উদ্দিন ও ইউসুফ আলী নামের দুই ব্যাক্তি গত ২৬ অক্টোবর(বৃহস্পতিবার) সকালের দিকে দলিল সম্পাদন করতে আসেন। কথা হলে বলেন,‘ দলিল সম্পাদন করতে আসার পর অবৈধ সমিতির নামে দিতে হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার ও অফিসের সাব রেজিস্ট্রারসহ অন্যদের জন্য নেওয়া হয়েছে আরো ৩ হাজার ৭০০ টাকা। প্রথম লাখের জন্য সাড়ে ৩ হাজার ও পরবর্তি প্রতি লাখে এক হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। তাদের মত আছিয়া ও ওবাইদুর রহমানকেও অবৈধ সমিতি ও অফিসের জন্য দিতে হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
দলিল লেখকরা বলেন, সারাদিন কত দলিল হয় তার হিসেব সন্ধ্যায় করা হয়। কোন দলিল লেখকের কার্যালয়ের মাধ্যমে কতটি দলিল সম্পাদন হয় কত টাকার দলিল হয় তার সব তথ্য দিতে হয়। সেই হিসেব অনুযায়ী রাতে সব দলিল লেখকের কাছ থেকে টাকা বুঝে নেন নেতারা। তাদের হিসেব অনুযায়ী প্রতি মাসে অবৈধ দলিল লেখক সমিতির নেতাদের পকেটে যাচ্ছে কমপক্ষে কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার বড় একটি অংশ ভাগ পান ক্ষমতাসীন দলের কুষ্টিয়া শহর আওয়ামী লীগের একজন নেতাসহ আরও কয়েকজন। বাকি টাকা যে ১৫০ থেকে ১৭৫জনের মত মুহুরি আছেন তাদেরকে অল্প পরিমান দেওয়া হয়। আর অবশিষ্ট টাকা সমিতির কয়েকজন নেতার নিয়ন্ত্রনে থাকে।
সাব-রেজিষ্টার কার্যালয়ের অফিস সহকারি রফিকুল ইসলাম প্রায় সাড়ে ৩ বছর ধরে চাকুরি করছেন এখানে। দলিল সম্পাদন করতে অফিসের খরচ ও অবৈধ সমিতির নামে চাঁদা নেওয়ার বিষয়ে কথা বললে তিনি কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। পরে প্রমানসহ কথা হলে তিনি বলেন,‘ আপনি স্যারের সাথে কথা বলেন। উনি সব বলতে পারবে।’ এরপর তিনি বলেন, আমাদের নাম করে বাইরে থেকে যদি কেউ টাকা নিলে সেটা তাদের বিষয়।
দলিল লেখক সমিতির সাধারন সম্পাদক সোহেল রানা আশা বলেন, একটি সমিতি আছে আমাদের। তার জন্য সমিতিসহ অন্যান্য খরচের জন্য মাত্র ৫০০ করে টাকা নেওয়া হয়। প্রতি লাখের হিসেবে যে অর্থ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটি আমার নলেজে নেই। সমিতির কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন,‘ সমিতির কোন সাধারন সভা ও নির্বাচন হয় না। সারাদেশেই আছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে আমরা লিয়াজো রাখি।’
আর সদর সাব-রেজিষ্টার কাওসার আলী বলেন,‘ আপনি যে বিষয়ে জানতে চেয়েছেন বা অভিযোগ করছেন সে বিষয়ে আমার কোন কিছু জানা নেই।’ আর জেলা রেজিস্ট্রার সৈয়দা রওশন আরাও এসব কিছুই জানেন না বলে সাব রেজিস্ট্রার অফিসে যোগাযোগ করার জন্য পরামর্শ দেন। কুষ্টিয়া সদর সাব রেজিস্ট্রারের কার্যালয় ছাড়াও বাকি আরো ৫টি উপজেলাতেও একই ভাবে অবৈধ সমিতির নামে রাজনৈতিক দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা চাঁদা নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।’
