খবরওয়ালা ডেস্ক \\ অপচিকিৎসায় একের পর এক মৃত্যু নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হওয়ায় টনক নড়ল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। মানহীন ও অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিক বন্ধে সারাদেশে আবারও চালানো হচ্ছে অভিযান। সেবার নামে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান করা হচ্ছে সিলগালা। আদায় করা হচ্ছে জরিমানাও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধভাবে অনেক হাসপাতাল চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাফিলতিতে। বড় কোনো ঘটনা ঘটলেই ঘুম ভাঙে প্রশাসনের। এর আগেও বিভিন্ন সময় চালানো হয়েছে অভিযান; কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অবৈধ প্রতিষ্ঠান শুধু বন্ধ করলেই হবে না, বছরজুড়ে থাকতে হবে তদারকি। হাইকোর্টের নির্দেশ পেয়ে অবৈধভাবে চলা ১ হাজার ২৭টি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে তালিকা স্থানীয় প্রশাসনে পাঠানো হয়। রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর প্রমাণ মেলায় এ উদ্যোগ নেওয়া হলো। সারাদেশে অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে গত মঙ্গলবার অভিযান শুরু হয়েছে। এটি চলবে আরও ১৫ দিন। দু’দিনের অভিযানে সারাদেশে ৩০টির বেশি হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে বন্ধ করা হাসপাতাল চালু করতে মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক মহল থেকে চাপ আসছে। এর আগেও এমন অভিযানের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালককে বদলি করা হয়। কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাহী ক্ষমতা না থাকায় বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিতে হয়েছে। নিবন্ধনধারী হাসপাতাল অধিদপ্তরের দেওয়া ১০ নির্দেশনা ভঙ্গ করলেও শক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর একটি অংশের নিবন্ধন নেই। এসব হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায় সেবা নিয়ে চরম অসন্তুষ্টি রয়েছে। প্রতিনিয়ত ওঠে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হলেও কিছুদিন পরই মন্ত্রণালয় ও রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরে চালু হয়ে যায়। রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের অবকাঠামো মানসম্মত নয়। এদিকে বৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ৮০ ভাগেরই যথাযথ অবকাঠামো নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। গত ৩০ ডিসেম্বর রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে মারা যায় শিশু আয়ান আহমেদ। এ ঘটনার পর হাইকোর্টের নির্দেশে অবৈধ হাসপাতালের একটি তালিকা আদালতে জমা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে তালিকায় নাম রয়েছে ১ হাজার ২৭টি প্রতিষ্ঠানের। নিবন্ধনহীন এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে ৬ ফেব্র“য়ারি নির্দেশ জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ‘চিকিৎসক ও রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব আমার। নিবন্ধন ছাড়া একটি হাসপাতালেরও সেবা পরিচালনা করার সুযোগ নেই। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আকাঙ্ক্ষা বা স্তবায়ন করা নিয়ে এরই মধ্যে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে লাইসেন্সধারী বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকের সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৩। এ ছাড়া আবেদন করে নিবন্ধনের অপেক্ষায় রয়েছে তিন হাজারের বেশি হাসপাতাল। অবৈধ হাসপাতাল বন্ধে অভিযানের খবর শুনে নিবন্ধন ও লাইসেন্স নবায়নের আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে চারশর বেশি আবেদন জমা পড়েছে। গত বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এদিন লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনা করায় রাজধানীর আসাদগেট এলাকার কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়। ছয় মাস আগেও এই হাসপাতাল বন্ধ করা হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নীরবে এটি চালু করে মালিকপক্ষ। এর আগে ২০২১ সালের ১০ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে ছয়টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং একটি বøাড ব্যাংক বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই বছরের ব্যবধানে এ ভবনে ১৮টি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এবারের অভিযানে লাইসেন্স না থাকায় এ ভবনে তিনটি হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে হাসপাতাল চালানোর দায়ে রাজধানীর উত্তরার হাইকেয়ার কার্ডিয়াক অ্যান্ড নিউরো স্পেশালাইজড হাসপাতালের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় দিনের মতো অবৈধ ক্লিনিক, হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাড ব্যাংকে চালানো অভিযানে পাওয়া যায় নানা অনিয়মের প্রমাণ। উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে হাইকেয়ার জেনারেল হাসপাতালে লাইসেন্সের কাগজপত্র ঠিক থাকলেও জেনারেল হাসপাতালে পরীক্ষার ল্যাব দেখা গেছে নোংরা। নিয়ম অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়নি বিভিন্ন পরীক্ষার নমুনা। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে এ নিয়ে সতর্ক করে অধিদপ্তর। পরে রাস্তার উল্টো দিকে তাদেরই আরেক শাখা হাইকেয়ার কার্ডিয়াক অ্যান্ড নিউরো স্পেশালাইজড হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, কাজ চলছে শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই। সেখানে ২৫ জন রোগী চিকিৎসাধীন। সব মিলিয়ে রাজধানীতে দু’দিনে ৯টি হাসপাতাল বন্ধ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে সতর্ক করা হয়েছে। গতকাল বিভিন্ন এলাকায় ১০টি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে তিনটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সেগুলো হলো মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের কেয়ার হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক, শ্যামলী এলাকার ঢাকা ট্রমা সেন্টার ও স্পেশালাইজড হাসপাতাল, উত্তরা হাইকেয়ার নিউরো ও কার্ডিয়াক হাসপাতাল। গত মঙ্গলবার ছয়টি হাসপাতাল বন্ধ করা হয়। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে লাইসেন্স না থাকায় লাইফ সেভার ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং হেলথ ভিউ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। একই সঙ্গে দুই প্রতিষ্ঠানকে ৮০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বুধবার উপজেলার ভাটিয়ারী এলাকায় এই অভিযান পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনুমোদন না থাকায় নীলফামারীতে পাঁচটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার সিলগালা করা হয়েছে। এ ছাড়া ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। বুধবার দুপুরে এ অভিযান চালানো হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে ডোমার উপজেলার আনছার আলী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ট্রাস্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার, নিউলাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও সৈয়দপুর উপজেলার ল্যাবএইড ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সিলেট বিভাগের আটটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স না থাকায় বন্ধ করে দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে আছে হবিগঞ্জে চারটি, সিলেটে দুই ও মৌলভীবাজারে দুটি। বুধবার সিলেট নগরী ও মৌলভীবাজার শহরে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য বিভাগ। সিলেট নগরীর সেফওয়ে হাসপাতাল, আয়েশা মেডিকেয়ার, আরটিএম হাসপাতালসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র যাচাই করা হয়। আভিযানিক দল দেখতে পায়, এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিক নবায়নের জন্য অনলাইনে আবেদন করে বসে আছে। তাদের লাইসেন্স থাকলেও নবায়ন না থাকায় দ্রুত নবায়ন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন আছে অথচ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব শর্ত মানছে না, পরিস্থিতির উন্নতি করার জন্য তাদের তিন মাস সময় দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তিন মাস হয়ে যাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যারা নিয়ম মেনে লাইসেন্স রিনিউ বা নতুন লাইসেন্স নেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন অভিযান চালানো হবে। বুধবার দুপুরে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর এলাকায় সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়। এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, হৃদরোগ হাসপাতাল, শিশু হাসপাতাল ও পঙ্গু হাসপাতাল থেকে দালাল চক্রের ৩৮ জনকে আটক করে র্যাব। এদের মধ্যে ১২ জনকে কারাদন্ড ও ২৬ জনকে অর্থদন্ড দেওয়া হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাব-২-এর উপঅধিনায়ক মেজর নাজমুলাহেল ওয়াদুদ। তিনি বলেন, সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্যরা এসব হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও রোগীর আত্মীয়স্বজনকে দ্রুত ও ভালো চিকিৎসাসেবার আশ্বাস দিয়ে বিভিন্নভাবে বিরক্ত করত। তারা অল্প সময়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে তাদের থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মইনুল আহসান বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে সেবার মানোন্নয়নে ১০টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, অভিযানে বেসরকারি হাসপাতালের কোনোটাতেই শতভাগ নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি। অনেক হাসপাতালে নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অপারেশন থিয়েটার। অনেক হাসপাতালে সেবার মান, যন্ত্রপাতি, পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন ত্রæটি রয়েছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান ভ‚ঁইয়া বলেন, হাসপাতালে শৃঙ্খলা ফেরাতে ও সেবার মানোন্নয়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১০ দফা নির্দেশনা সব হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। কীভাবে এটি বাস্তবায়ন করা যায়, এ নিয়েও বৈঠক হয়েছে। অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা হোক– এটা আমরাও চাই। সরকারি বিধান না মেনে যাতে কেউ প্রতিষ্ঠান করতে না পারে, সে জন্য কঠোর নজরদারি থাকতে হবে। তবে কোনো প্রতিষ্ঠান অযথা হয়রানির শিকার যেন না হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার কারণে সব চিকিৎসকের বদনাম করা ঠিক হবে না। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে ও ভুল চিকিৎসা বন্ধে অভিযান চলমান থাকবে। বেসরকারি হাসপাতালকে নিয়মের মধ্যে আনতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হবে।
