বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা বিভাগের অন্তর্গত কুষ্টিয়া জেলা কেবল একটি প্রশাসনিক অঞ্চলই নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিল্পঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ এক কেন্দ্র। প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক উন্নয়নের এক অপূর্ব মেলবন্ধন রয়েছে এ জেলায়। আজ আমরা সংক্ষেপে জেনে নেব কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয়ের ইতিহাস, ভৌগোলিক গুরুত্ব, এবং তার সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক বিকাশের ধারা।

কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয়
কুষ্টিয়া প্রাচীন কোনো নগরী নয়। এর নগরায়নের সূচনা ঘটে মূলত মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে। সে সময় এখানে একটি নদীবন্দর গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে কুষ্টিয়ার নগরায়নের সূচনা হয় নীলচাষ ও নীলকরদের আগমনের পরে।
১৮৬০ সালে কলকাতার (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী) সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপন কুষ্টিয়াকে এক শিল্প সম্ভাবনাময় অঞ্চলে পরিণত করে। ফলে, এখানে গড়ে ওঠে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেমন—
- যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস (১৮৯৬),
- রেণউইক, যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং (১৯০৪),
- মোহিনী মিলস (১৯১৯)।
এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান নগর বিকাশে নতুন গতি সঞ্চার করে।

প্রশাসনিক উন্নয়ন
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হলে কুষ্টিয়া একটি পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার আওতাভুক্ত ছিল কুষ্টিয়া সদর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর মহকুমা।
১৯৫৪ সালে এসডিও মৌলভি আব্দুল বারী বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঙ্গা–কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের সদর দপ্তর কুষ্টিয়ায় স্থাপন করা হয়। এরপর একে একে আরও বেশ কিছু সরকারি দপ্তর ও অফিস কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরিত হলে শহরটির উন্নয়ন নতুনভাবে শুরু হয়।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
কুষ্টিয়া জেলাকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী বলা হয়। এখানে বসবাস করেছেন ও কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটিয়েছেন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি।
- শিলাইদহে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি, যেখানে তিনি রচনা করেছিলেন তার বহু কালজয়ী কবিতা ও গান।
- কুমারখালীতে রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা।
- ছেউড়িয়াতে রয়েছে ফকির লালন সাঁইজির মাজার, যা দেশের অন্যতম প্রধান সুফি তীর্থস্থান।
- এখানে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি ইসলাম বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়—ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, যা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেও স্বীকৃত।
শিক্ষা ও যোগাযোগ
কুষ্টিয়ায় বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন—জগতি রেলওয়ে স্টেশন অবস্থিত।
এখানে রয়েছে দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়—কুমারখালি পাইলট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়।
শিল্প ও অর্থনীতি
কুষ্টিয়া জেলার শিল্পকারখানা ও বিদ্যুৎখাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে।
- জেলার কুষ্টিয়া শহর ছাড়াও কুমারখালী ও ভেড়ামারা পৌরসভাগুলিতে বিসিক শিল্প এলাকা গড়ে উঠেছে।
- ভেড়ামারায় অবস্থিত বাংলাদেশের বৃহত্তম তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ
কুষ্টিয়া জেলার মানুষের মুখের ভাষা বা কথ্য রূপকে বাংলাদেশের সবচেয়ে শুদ্ধ বাংলা বলা হয়। এখানকার প্রমিত উচ্চারণ ও ভাষাগত কাঠামো অনেকটা রেডিও ও টেলিভিশনের সংবাদ ভাষার কাছাকাছি।
এ জেলা থেকেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। ১৯৭১ সালের মার্চেই এ জেলার মাটি রক্তে রঞ্জিত হয় এবং এখানকার সাহসী মানুষরা প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

কুষ্টিয়া জেলার অভ্যুদয় কেবল একটি শহরের গঠনের ইতিহাস নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতিক চেতনা, প্রশাসনিক বিকাশ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অমূল্য অধ্যায়। ইতিহাস, শিল্প, সাহিত্য, শিক্ষা ও রাজনীতির মেলবন্ধনে কুষ্টিয়া বাংলাদেশের মানচিত্রে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।
