‘মাসখানেক আগেও সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। গোয়ালভরা গরু, ঘরভরা ধান, চাল, আসবাবপত্র, দোকান ভরা মালামাল, টিভি, ফ্রিজ সবকিছু। মাঠজুড়ে সরিষা, খেসারী, কালোজিরা ফসল। কিন্তু এক মাস তিনদিন পরে ফিরে দেখি আমার সব শেষ, তছনছ হয়ে গেছে। আধাপাকা ঘর গুলো ভেঙে মাটিতে শুয়ে আছে। কোনো মালামাল নেই। ভাঙা ঘরের চালের টিন নেই। টয়লেট ভাঙা। পানি খাওয়ার কলও লুট করে নিছে ওরা। আক্ষেপ করে কথা গুলো বলছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ মো. মকবুল বিশ্বাস (৭৫)। একটি খুনে ধ্বংস চর জগন্নাথপুর গ্রাম।
একটি খুনে ধ্বংস চর জগন্নাথপুর গ্রাম!

তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা। ওই গ্রামের পল্লী চিকিৎসক আব্দুর রাজ্জাক হত্যার পর হামলা ও মামলার ভয়ে তিনি ঘরবাড়ি রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় এক মাস তিন দিন বিভিন্ন স্বজনদের বাড়ি ও পথেপথে বেড়িয়ে গত রোববার গ্রামে ফিরেছেন তিনি। তিনি পেশায় একজন কৃষক ও মুদি দোকানদার। তিনি আসামী না হলেও তাঁর বড় ছেলে সবুজ ওই হত্যার মামলার প্রধান আসামী।
শুধু মকবুল বিশ্বাস নয়, ওই ঘটনায় হামলা, মামলা ও প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলেন আসামীপক্ষের প্রায় শতাধিক পরিবার। তাঁদের প্রতিটি ঘরবাড়িতেই ভাংচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। গত রোববার বিকেলে প্রায় ৩০ টি পরিবার গ্রামে ফিরেছেন। তাঁদের মধ্যে জামিনে থাকা আসামীরাও রয়েছে। ভাঙা ঘরবাড়িতে পলিথিন ও ত্রিপল দিয়ে তাবু টাঙিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তাঁরা। তাঁদের টয়লেট ও সুপেয় পানির ব্যবস্থাও নেই।
আসামীপক্ষের লোকদের অভিযোগ, ঘটনার পর থেকেই তাঁদের গ্রামে ২৪ ঘণ্টা পুলিশ পাহাড়ায় থাকে। তবুও বাদীপক্ষ ও তৃতীয়পক্ষের লোকজন তাঁদের ঘরবাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট করেছেন। মাঠের ফসল কেটে নিয়ে গেছেন। এতে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাঁদের।

তাঁদের ভাষ্য, পুলিশের পাহাড়ায় ও যোগসাজশে এমন ভাংচুর ও লুচপাট করা হয়েছে। অতর্কিত হামলার শঙ্কায় কাঁটছে তাঁদের দিন-রাত। এবিষয়ে জামিনে থাকার মামলার ১৩ নম্বর আসামী ইদ্রিস বিশ্বাসের ছেলে সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনি পেশায় একজন কৃষক ও রাইচ মিলের ব্যবসায়ী। তিনি ওই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত নন। তবুও গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়েছিলেন, আর বাদীপক্ষের লোকজন তাঁর পরিবারের সদস্যদের গ্রাম থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেন। সেই সুযোগে বাদীপক্ষের লোকজন পুলিশ পাহাড়ায় তাঁর রাইচ মিল ও বসতবাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করেছে। মাঠের ফসল কেটে নিয়ে গেছে। এতে তাঁর প্রায় ২০ লক্ষ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
শুক্রবার দুপুরে চর জগন্নাথপুর গ্রামে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, আসামীপক্ষের প্রায় শতাধিক পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা ঘরবাড়িতে ভাংচুরের ক্ষত রয়েছে। আসবাবপত্র, গোবাদিপশুসহ কোনো মালামাল নেই। ভাংচুর ঘর গুলো মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। অধিকাংশ ঘরের চালা নেই। প্রতিটি বাড়ির টিউবওয়েল ও টয়লেট ভাঙা। কয়েকটা স্থানে তাবু টাঙানো রয়েছে। সেখানে কাঠের চৌকিতে শুয়ে-বসে আছে কিছু মানুষ। অন্য এলাকার স্বজনরা তাঁদের খাবার ও পানির যোগান দিচ্ছেন। তবে কোথাও পুলিশের দেখা মিলেনি।
এসময় কথা হয় হাসেন প্রামাণিকের ছেলে জিয়াউর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, তিনি পেশায় একজন ঠিকাদারী ব্যবসায়ী। ঘটনার সময় তিনি ঢাকাতে ছিলেন। তবুও তাকে ১৫ নম্বর আসামী করা হয়েছে। ঘটনার দিনই তাঁর পরিবারের সদস্যদের গ্রামছাড়া করেছেন আসামীপক্ষের লোকজন। পরে তাঁর পাকা একতলা বিল্ডিং ভাঙা হয়েছে। বাড়ির মালামাল ও গরু এবং মাঠের ফসল লুট করা হয়েছে।
জানা যায়, সুদে টাকার জেরে ২ ফেব্রুয়ারি সকালে জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান মেম্বর মো. সজিব বিশ্বাস ওরফে সবুজের (৩৫) সাথে সাবেক মেম্বর জাবেদ আলী বিশ্বাসের সংঘর্ষ হয়। এতে সাবেক মেম্বরের ভাতিজা পল্লী চিকিৎসক আব্দুর রাজ্জাক নিহত হন। গুরুতর আহত হন সাবেক মেম্বরও। এঘটনায় ওইদিন রাতেই নিহতের বড় ভাই মো. আক্কাস আলী বিশ্বাস বাদী হয়ে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় বর্তমান মেম্বরকে প্রধান আসামী করে ২১ জনকে আসামী করা হয়। এছাড়াও মামলায় আরো ১০/১২ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামী করা হয়।
আরো জানা যায়, এঘটনায় হামলা, মামলা, গ্রেফতার ও প্রাণভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যান আসামীপক্ষের প্রায় শতাধিক পরিবারের লোকজন। সেই সুযোগে ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেম্বর মো. আবুল কাশেম ও বাদীপক্ষের সমর্থকরা আসামীপক্ষের বাড়িতে ভাংচুর ও লুটপাট করে। তাঁরা মাঠের ফসলও কেটে নিয়ে গেছে। পরে ভাংচুর ও লুটপাটের অভিযোগে আসামীপক্ষের লোকজন থানায় ৪ টি এবং আদালতে একটিসহ মোট পাঁচটি মামলা দায়ের করেন। তবুও পুলিশের পাহাড়ায় দিন রাত বেঁধে চলে ভাংচুর-লুটপাট।
এবিষয়ে মামলার প্রধান আসামী সবুজের ভাই সরুজ বিশ্বাস বলেন, কাশেম মেম্বর, মামলা বাদী ও বাদীপক্ষের সমর্থকরা তাঁদের ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে মাটিতে মিশিয়ে দিছে, লুটপাট করেছে। তবে তাঁরা আর মারামারি, ভাঙাভাঙি, লুটপাট চাইনা। এখন আবার সবাই মিলেমিশে আগের মত বসবাস করার কথা জানান তিনি।
অভিযোগ অস্বীকার করে ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক ইউপি সদস্য মো. আবুল কাশেম বলেন, বাদীপক্ষের লোকজন এলাকায় ভাংচুর-লুটপাট করছেন। তিনি বা তাঁর লোকজন একাজে জড়িত নয়। তবুও তিনিসহ তাঁর লোকজন মিথ্যে মামলার আসামী হয়েছেন। বর্তমানে তাঁরা জামিনে রয়েছেন।
অভিযোগ অস্বীকার করে মামলার বাদী মো. আক্কাস আলী বিশ্বাস বলেন, সুদে টাকার জেরে তাঁর চিকিৎসক ভাইকে হত্যা করেছেন প্রতিপক্ষরা। বিচারের প্রত্যাশায় তিনি থানায় মামলা করেছেন। কিছু আসামী জামিনে বের হয়েছেন। তবে কে বা কাহারা রাতের আধাঁরে আসামীপক্ষের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর বা লুটপাট করেছে তা তিনি জানেনা। তিনি আরো বলেন, মামলা চলবে মামলার গতিতে। তিনিও আর মারামারি চায়না। এখন এলাকায় শান্তি প্রত্যাশা করেছেন তিনি।
জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল বাকী বাদশা বলেন, এলাকায় ধ্বংস স্তুপ ছাড়া আর কিছুই নেই। পুলিশের সামনেই চলছে ভাংচুর। চেয়ারম্যানের ভাষ্য, পুলিশের সংখ্যার চেয়ে ভাংচুরকারীদের সংখ্যা বেশি থাকে। সেজন্য ভয়ে পুলিশ প্রতিরোধ করতে পারেনা।
কুমারখালী থানার ওসি মো. মোহসীন হোসাইন বলেন, ঘটনার পর থেকেই এলাকায় পুলিশের পাহাড়া রয়েছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। একটি হত্যা ও চারটি ভাংচুর মামলা হয়েছে থানায়। কিছু আসামী জামিনে ও পলাতক রয়েছে। গ্রামটিতে পুলিশের কঠোর নজরদারি রয়েছে। তবে ভাংচুরের বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি ওসি।